"তোওো- চান "

 
#ক্যাটাগরিঃঃ বুক_রিভিউ
#নামঃ তোত্তো-চান : জানলা ধরে দাঁড়িয়ে থাকা ছোট্ট মেয়েটা
#মূল_লেখক : তেৎসুকো কুরোয়ানাগি
#অনুবাদ : মৌসুমী ভৌমিক 
 
আচ্ছা কল্পনা করুন তো, একটা স্কুল যেখানে গতানুগতিক কোনো ইট পাথরের বিল্ডিং কিংবা চার দেয়ালে ঘেরা কোনো ক্লাসরুম নেই, বরং ট্রেনের পরিত্যক্ত বগিকে ক্লাসরুম হিসেবে ব্যবহার করা হয়। অবশ্যই বগিটিকে সাজিয়ে গুছিয়ে ক্লাসের উপযোগী করে নেয়া হয়। আর সেই স্কুলে আছে এমন সব নিয়ম আর শিক্ষাদানের পদ্ধতি যা শুনলে মনে হবে, ইশ! আমিও যদি এই স্কুলটায় পড়তে পারতাম? 
আমি আপনি না পড়তে পারলেও একজন কিন্তু সেই স্কুলে পড়ার সুযোগ পেয়েছিলো। একটা ছোট্ট মেয়ে... যার নাম তোত্তো-চান। সেই মেয়েটি বড় হয়ে একটা বই লিখে ফেললো তার স্কুলের স্মৃতিগুলো নিয়ে। আমার রিভিউ সেই বইটিকে নিয়েই...। 
 
চলুন আমরা মেয়েটির সাথে সাথে তার ছোটবেলায় ফিরে যাই আর দেখি কেমন ছিল সেই স্বপ্নের মত স্কুলটি...।
তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা বেজেছে দিকে দিকে। সবাই চিন্তিত যুদ্ধের পরিণাম নিয়ে। কিন্তু ছোট্ট তোত্তো-চান তো এতকিছু জানে না৷ সে চলেছে তার নতুন স্কুলে মায়ের সাথে। আগের স্কুল থেকে তাকে তাড়িয়ে দিয়েছে কি না। কারণ আর কিছুই নয়, স্কুলের দিদিমণির অভিযোগ তোত্তো-চান নাকি গোটা ক্লাসকে বিরক্ত করে! সে রাস্তার বাজনাদারদের ডেকে ডেকে কথা বলে, বাজনা বাজাতে অনুরোধ করে। এতে করে অন্য বাচ্চারাও পড়াশোনা রেখে খেলায় মেতে উঠে। এসব কারণে দিদিমণি তোত্তো-চানকে আর এই স্কুলে রাখতে চান না। 
তাই তোত্তো-চানকে তার মা নতুন স্কুলে ভর্তি করাবে বলে ঠিক করে। কিন্তু নতুন স্কুলেও যদি তোত্তো-চানের সরল ফুলের মত মনটা কেউ না বুঝে? যদি আবার তাড়িয়ে দেয়? এই নিয়ে তার মা কিছুটা চিন্তিত। কিন্তু তোত্তো-চান কি করছে? ওই দেখো সে স্টেশনের টিকিট চেকারের সাথে কথা বলছে। সে নাকি বড় হয়ে টিকিট বিক্রি করবে! বোঝো! এই সেদিন সে তার মাকে বলছিলো সে বড় হয়ে গুপ্তচর হবে! এমনই উড়ুউড়ু মন তার। এই ছোট্ট মেয়েটাকে তার মত করে বুঝবে এমন স্কুল কি আছে?
 
ওই তো নতুন স্কুলের গেট দেখা যাচ্ছে। সাইনবোর্ডে একটা নামও আছে - "তোমোই গাকুয়েন"। কিন্তু স্কুলে ঢোকার আগেই তোত্তো-চান বিস্মিত। কেন? আরে এই স্কুলেই তো রেলগাড়ির কামরায় ক্লাস হয়। তোত্তো-চান তো খুব খুশী এমন রেলগাড়ি স্কুল দেখে। সে তো চাইছিলো এক দৌড়ে ক্লাসে ঢুকে যেতে, কিন্তু তার মা আটকে দিলেন। কেননা তোত্তো-চান তো এখনো এই স্কুলে ভর্তিই হয়নি। আগে ভর্তি হওয়া তবে না রেলগাড়িতে ক্লাস করা!
 
চলুন দেখি তোত্তো-চান স্কুলে ভর্তি হতে পারলো কিনা? দেখা যাচ্ছে তোত্তো-চানের ইন্টারভিউ হচ্ছে। কেমন ইন্টারভিউ? খুব সহজ। তোত্তো-চানকে শুধু তার যা মন চায় তাই বলে যেতে হবে। হেডস্যার সেই সব কথা মন দিয়ে শুনবেন। এই স্কুলে ভর্তি হওয়ার জন্য কোনো বাঁধাধরা প্রশ্ন-উত্তরের পর্ব নেই।  কি চমকে গেলেন? এইতো সবে শুরু। এই স্কুলের সব নিয়মই আপনাকে চমৎকৃত করবে।
 
চারঘন্টা হয়ে গেলো। এই সবে তোত্তো-চানের কথা শেষ হলো। তার মনে যে এত কথা ছিল কে জানতো? এমন করে তার কথা মন দিয়ে কেউ কখনো শোনেনি। তোত্তো-চান প্রথমদিনেই তার হেডস্যারটিকে ভীষণ পছন্দ করে ফেললো। আর শুধু নিজের কথা বলেই তোত্তো-চান এই স্কুলের ছাত্রী হয়ে গেলো।
 
এবার হেডস্যার তাকে নিয়ে গেলেন স্কুলের খাওয়ার ঘরে। এখন লাঞ্চ টাইম কিনা। এখানেও আছে সুন্দর একটা নিয়ম। খাবার খেতে হবে "সাগর থেকে, পাহাড় থেকে"। কি কিছু বুঝলেন না বোধহয়? বুঝিয়ে বলছি। আমাদের স্বাস্থ্য ভালো রাখার জন্য দরকার সুষম খাদ্য যাতে সবরকম পুষ্টি উপাদান বিদ্যমান থাকে। "সাগর থেকে, পাহাড় থেকে" মানে হলো সেই পুষ্টিকর খাবার। "সাগর থেকে" মানে কোনো সামুদ্রিক খাবার যেমন সামুদ্রিক মাছ বা চিংড়ি ইত্যাদি। আর "পাহাড় থেকে" মানে শাকসবজি বা মুরগী, ডিম ইত্যাদি। শুধু ভাত দিলেই হবে না, সেই সাথে মাছ বা মাংস এবং শাকসবজির সুষম বন্টন নিশ্চিত করতে হবে, যাতে করে বাচ্চাদের খাবারের পুষ্টিমান বজায় থাকে। 
হেডস্যার তাই সব ছাত্রছাত্রীদের মাকেই বলে দিয়েছেন টিফিন দেয়ার সময় যাতে "সাগর থেকে, পাহাড় থেকে" কথাটি মাথায় রাখেন। কিন্তু কেউ যদি ভুলে যায় একই সাথে 'সাগর থেকে আর পাহাড় থেকে' খাবার দিতে? উহু চিন্তার কিছু নেই। ওই তো খাবারঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছেন হেডস্যারের স্ত্রী। যখনই হেডস্যার দেখেন কেউ কোনো একটা উপাদান আনতে ভুলে গেছে, অমনি তিনি হেঁকে বলেন, "সাগর" অথবা "পাহাড়"। আর হেডম্যাম সেই অনুযায়ী হাতায় করে খাবার তুলে দেন বাচ্চাদের। 
কি মজার না?
শুরুতেই বলেছি এই স্কুলের নিয়মকানুনগুলো অনেক আলাদা। ভর্তি প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে খাবার, পড়াশোনা, খেলাধুলা কোনোকিছুই এর ব্যতিক্রম নয়। এখানে গতানুগতিক নির্দিষ্ট সময় আর বিষয় নির্ধারণ করে ক্লাস হয় না৷ বরং যেটা হয়, প্রতিদিন ক্লাসের শুরুতে প্রতিটা ক্লাসের শিক্ষক বা শিক্ষিকা ছাত্রছাত্রীদের ওইদিনের একটা কার্যতালিকা তৈরি করে দেন। যেমন আজকে আমরা এটা এটা শিখবো, এই এই কাজ করবো ইত্যাদি। তারপর ছাত্রছাত্রীদেরকে বলা হতো, তালিকা থেকে তোমরা তোমাদের পছন্দমত কাজ বেছে নিয়ে তোমাদের দিন শুরু করো। তখন দেখা যেতো একই ক্লাসের মধ্যে সবাই কিছু না কিছু করছে কিন্তু সেটা কারো চাপিয়ে দেয়া না। বরং নিজের পছন্দ অনুযায়ী। কেউ হয়ত ছবি আঁকছে, তারই পাশে আরেকজন অঙ্ক কষছে, আরেকজন হয়ত বিজ্ঞানের নানা অলিগলিতে বিচরণ করছে। 
এইভাবে পড়ানোর উদ্দেশ্য হলো, ছাত্রছাত্রীদের কোনদিকে উৎসাহ বেশী আর কোন বিষয়টাতে তারা ভালো করছে সেটা স্পষ্ট করে বুঝতে পারা৷ এভাবে প্রতিটি ছাত্রছাত্রীর নিজস্ব বৈশিষ্ট্যকে চিহ্নিত করা যায়। 
দিনের শুরুটা এভাবে পছন্দের বিষয় দিয়ে করে তারপর এক এক করে কার্যতালিকার বাকি বিষয়গুলোও ছাত্রছাত্রীরা সম্পন্ন করে থাকে। এতে করে সব বিষয়েই তারা মোটামুটি ধারণা লাভ করে। 
 
এভাবেই সত্যিকারের পড়াশোনা হতো তোমোই-তে। টিচার ক্লাসে বকবক করছে আর ছাত্রছাত্রীর মন নেই ক্লাসে - এমন পড়াশোনায় কার লাভ হয়? তার থেকে ছাত্রছাত্রীদের নিজেদের পছন্দের কাজ করতে অনুপ্রাণিত করা আর কোথাও যদি সে ঠেকে যায় তখন তাকে দেখিয়ে দেওয়া - এটাই কি ভালো না? সে নিজে নিজে শিখতে শিখতেই ভুল করবে আর ভুল থেকেও শিখবে - এই শিক্ষা যত স্থায়ী হয় একজন টিচারের শত লেকচার এমন স্থায়ীভাবে শেখাতে পারে না। এই স্কুলে সঙ্গীতের উপরও খুব জোর দেয়া হতো। ইউরিদমিক্স নামে একটা পদ্ধতিতে এখানে ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গীত শিখানো হয়।  
 
তোত্তো-চানের জন্য এসবকিছু নতুন হলেও এই স্কুলের সবকিছুতেই সে ভীষণ আনন্দ খুঁজে পেতো। তোমোই-তে তার দিনগুলো ছিল সত্যিকারের স্বপ্নের মত। 
স্বপ্ন থাকলে স্বপ্নভঙ্গও থাকে৷ 'তোমোই' এর মত অসাধারণ একটা স্কুলের শেষ পরিণতি ছিল সেই স্বপ্নভঙ্গ। কি হয়েছিলো তোমোই-এর? জানতে হলে অবশ্যই আপনাকে বইটা পড়তে হবে।
 
বইটিতে স্কুলের কথা ছাড়াও তোত্তো-চানের জীবনের অনেক ছোট ছোট ঘটনার কথাও আছে। আছে তার স্কুলের বন্ধুদের কথা, তার কুকুর রকির কথা, তার বাবার বেহালা বাজানোর কথা। বইটা পড়লে একটা বাচ্চার মনোজগৎ সম্পর্কে বিচিত্র ধারণা লাভ করা যায়। বাচ্চাদের চিন্তাভাবনা আসলে কতটা আলাদা হতে পারে এই বইটা পড়লে বুঝা যায়। আর এই সময়েই তারা সবথেকে বেশী শিখে। চারপাশের ঘটনা থেকে, মানুষের কথাবার্তা থেকে। তাই একটা বাচ্চার সাথে মিশতে গেলে আপনাকে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে আপনি তার সামনে কিরকম ছবি তৈরি করছেন। 
 
বইটা কিন্তু সত্যি ঘটনার আলোকেই লেখা। বইয়ের শেষে লেখিকা তেৎসুকো কুরোয়ানাগি (হ্যাঁ, সেই ছোট্ট তোত্তো-চান) তার বর্তমান জীবন নিয়ে কিছু কথা বলেছেন। এছাড়াও তোমোই-এর অন্য ছাত্রছাত্রীরা বর্তমানে কে কোথায় আছে সেটাও উল্লেখ করেছেন। 
 
এত কথা বললাম, যদি তোত্তো-চানের মায়ের কথা না বলি তবে তো এই রিভিউ অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। মনে আছে তোত্তো-চানকে যে আগের স্কুল থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিলো? সেই কথাটা তোত্তো-চান জানতে পারে অনেক বড় হওয়ার পর। ওর মা কিন্তু ওকে এইজন্য কখনো বকাঝকা করেননি কেন ওকে স্কুল থেকে তাড়িয়ে দিলো? কেন ও স্কুলে শান্ত হয়ে থাকে না? বরং ওর মা ওকে ওর মত করেই বেড়ে উঠতে দিয়েছেন৷ ওর শৈশবের যে স্বাভাবিক দুরন্তপনা, যে সারল্য রয়েছে তার উপরে কোনো দায় চাপিয়ে দেননি কখনো। আজকের অনেক আধুনিক বাবা-মায়েরাও এতখানি মুক্তভাবে সন্তানের মানসিক জগৎকে বুঝতে পারেন না। এই বিবেচনায় বইটাকে বেশ শিক্ষণীয় বলা যায়।
 
#অনুবাদ_সংক্রান্ত: এই বইয়ের আর কোনো অনুবাদ আছে কি না জানিনা, আমি মৌসুমী ভৌমিকের অনুবাদকৃত বইটি পড়েছি। খুবই ভালো প্রাঞ্জল অনুবাদ। 
 
এই বইটি আমার প্রিয় বইয়ের তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে। তো বুঝতেই পারছেন, কতটা ভালো লেগেছে পড়ে। 
আপনি আর দেরী করছেন কেন? না পড়লে এখনই পড়ে ফেলুন! 
Posted in Education Blogs on November 30 2020 at 01:40 PM

Comments (2)

No login
color_lens
gif