ক্যাটগরি: বুক রিভিউ
বই: কবি
লেখক: তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
প্রকাশনা: মেসার্স আলিফ বুক হাউস
"শুধু দস্তুরমত একটা বিস্ময়কর ঘটনাই নয়, রীতিমত এক সংঘটন। চোর ডাকাত বংশের ছেলে হঠাৎ কবি হইয়া গেল।"
একপ্রকার নাটকীয়তার মধ্য দিয়েই যেন শুরুটা৷ এ কাহিনী এক ডোমবংশজাত ছেলের কাহিনী, তার তিনকুলে চোর, ডাকাত, খুনি আর দস্যু ছাড়া কোনও আত্মীয় নেই। সেই ছেলের কবি হয়ে যাওয়া রীতিমতো অঘটনই বটে!
মনে মনে ভাবলাম, "নাহ একটা মজার গল্প পড়তে যাচ্ছি বোধহয়।" কিন্তু হাসি কই? যতই এগিয়ে চললাম বইয়ের পাতায় মুখের হাসিটা ক্রমশ সঙ্কুচিত হয়ে এল, ধীরে ধীরে তা মনে হতে লাগলো যেন বিষাদের ছায়া। নাহ এই গল্প সুখের নয়। তবে কি অপ্রাপ্তির? কিছুটা হয়তো, কিন্তু প্রাপ্তিরও। সোজাসুজি বলতে গেলে এই উপন্যাস অসামান্য জীবনবোধের, শিল্প সত্ত্বার জাগরণের, প্রেম ও বিরহের, এবং নিজেকে নতুন করে খুঁজে নেওয়ার।
শুরু থেকে শেষ অবধিই গল্পের মূল চরিত্র নিতাইয়ের আত্ম-অনুধাবনের দৃশ্য। এক একটি কবিতা তার মনে বাসা বেঁধেছে এক একটি প্রেক্ষাপট কেন্দ্র করে। কখনও তার কাব্যের প্রেরণা প্রথম প্রেম ঠাকুরঝি, কখনো প্রকৃতি, কখনো চঞ্চলা বসন্ত, কখনও অপমান, কখনও বিয়োগ জ্বালা। তবুও প্রতিটি উৎস থেকে কাব্য এসে ভরিয়ে দিয়েছে তার সমস্ত মন। সুরেলা গলায় সাজিয়েছে সুরের সম্ভার।
কাব্যের মধ্যে দিয়ে যেন যুগের পর যুগের চিরসত্য উঠে এসেছে সহজভাবে -
"কালো যদি মন্দ তবে কেশ পাকিলে কাঁদ কেনে?"
আমরা কালো ত্বক দেখলে ব্যথিত হই, কিন্তু আবার সেই কালো চুলের ভিড়েই খুঁজে নিতে চাই নারীর সৌন্দর্য। গ্রীষ্মের দাবদাহে অতিষ্ট হয়ে কালো মেঘ না দেখলে বরং শঙ্কিত হই। তবে এই কালো কি সত্যিই খারাপ? না। পৃথিবীতে ভাল-মন্দ, খারাপ-সঠিকের বিষয়গুলো বড় আপেক্ষিক, পরিস্থিতি সাপেক্ষে পরিবর্তনশীল। । লেখকের ভাষায়-
"মোহন্ত হাসিয়া হাত তুলিয়া ইঙ্গিতে নিতাইকে বাধা দিলেন, বলিলেন- প্রভুর সংসারে নীচ কেউ নেই বাবা। নিজে, পরে নয়- নিজে নীচ হলে সেই ছোঁয়াচে পরে নীচ হয়। নীল চশমা চোখে দিয়েছ বাবা? সূর্যের আলো নীলবর্ণ দেখায়। তোমার চোখের চশমার রঙের মতো তোমার মনের ঘৃণা পরকে ঘৃণ্য করে তোলে।"
আমাদের মন অন্যের নোংরাটুকু কেবল চোখের সামনে সাজিয়ে ধরে। তখন আর অন্যের ভালো কাজগুলো দেখা যায় না, বরং তাকে কেবল ঘৃণা হয়। এই ঘৃণা ত্যাগ করা সহজ নয়। যারা ত্যাগ করতে পারে কেবল তারাই পেতে পারে মনুষ্যত্বের শ্রেষ্ট আসন। গল্পের প্রধান চরিত্র নিতাই সেই আসন স্পর্শ করেছে নিজের সুরে, কাজে, কথায় এবং দৃষ্টি ভঙ্গীতে।
উপন্যাসটি এক নিচু বংশের যুবকের কবি হওয়ার প্রবল ইচ্ছাকে প্রতিষ্ঠিত করার সংগ্রামকে ভিত্তি করে আবর্তিত। যেখানে তার প্রেমের বিষয়গুলোও কবিতার মতো গুরুত্বপূর্ণ। কবি নিতাই তখনই কবিতা বেঁধেছে যখন তার জীবনে প্রেম এসেছে৷ প্রেম থেকে কষ্ট এসেছে। না পাওয়ার যন্ত্রনা এসেছে।
তার ও ঠাকুরঝির মধ্যেকার প্রণয় যখন পরিনতি পেলোনা, অফুরন্ত তার জন্য ঠাকুরঝি সব হারাতে বসেছে সেই চিন্তাতেই যেন ঝুমুর দলের ডাকে নিতাই সমস্ত ভালবাসা, মায়াকে বিসর্জন দিয়ে চলে যায়।
নতুন জীবনে ভালবাসা ও আসে। বসন্ত কে আপন করে সমস্ত প্রণয় উজাড় করে দিতেই চায় নিতাই। সমাজের সমস্ত দোটানা, রটনা কে উপেক্ষা করে বসন্ত কে মেনে নেয় নিতাই। ক্রমে ক্রমেই তার কবিসত্তার বিকাশ ও ঘটতে থাকে।
কিন্তু সুখ তার বেশিদিন স্থায়ী আর হলো না।
শেষ চেষ্টাতে ব্যর্থ হয়ে বসন্ত কে গঙ্গার পারে সমাহিত করে যখন তার জীবনের ভবিষ্যৎ নিয়ে সংকট তখন হঠাৎ যেন গ্রামের প্রতি, ঠাকুরঝির প্রতি ভালবাসার টানে ফিরে আসে।
কিন্তু! হায় অদৃষ্ট।
"এই খেদ আমার মনে-
ভালোবেসে মিটল না সাধ, কুলাল না এ জীবনে!
হায়- জীবন এত ছোট কেনে?
এ ভুবনে?"
এক কথায়, এই উপন্যাস একটি জীবন্ত দীর্ঘশ্বাস। বাংলা সাহিত্যের এক অনবদ্য সৃষ্টি, "কবি", যা একবার নয় বহুবার পড়া যায়, এবং প্রতিবারেই নিত্যনতুন আবিষ্কারের আনন্দ উপভোগ করা সম্ভব।
ঔপন্যাসিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় এর প্রকৃতি, পরিবেশ ও পরিস্থিতির বর্ণনাও অনবদ্য। তাঁর এ চমৎকার বর্ণনা শক্তির জন্য উপন্যাসের প্রতিটি চরিত্র যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছিলো। ১৯৪৪ সালে প্রকাশিত উপন্যাসটি বাংলা সাহিত্যে এখনো অনন্যতা, নিজস্বতার জন্য পাঠক নন্দিত।
Comments (1)