#inspiringmillion #Bangladesh #StoryOfInspirations #Bangladesh #BijoyDibosh #nationalvictoryday #victoryday #16thDecember #49YearsOfVictory
#team: বঙ্গবন্ধুর সহযোদ্ধা
বইয়ের নাম: উইটনেস টু সারেন্ডার
(পাকিস্তানি এক সেনার বয়ানে মুক্তিযুদ্ধ)
মুল লেখক: সিদ্দিক সালিক,
বাংলা অনুবাদ সম্পাদনা: আজিজুল হক (সবুজপাতা প্রকাশনী)
রিভিউ দাতার নামঃ মো: আবুল খায়ের সুমন
ঠিকানা: বুড়িচং, কুমিল্লা৷
ইমেইলঃ sumon352121@gmail.com
#বুক_রিভিউ
“একজন হৃদরোগীর মতো নীরবে ঢাকার পতন ঘটলো। কোন অঙ্গচ্ছেদ ঘটলো না কিংবা দেহ দ্বিখণ্ডিত হলো না ৷ একটি স্বাধীন নগরীর সত্তা বিলুপ্ত হলো মাত্র” -সিদ্দিক সালিক ৷
বিজিত পক্ষই সবসময় ইতিহাস লিখে থাকে৷ তাদের কলমের কালো দাগে ভরে ওঠে ইতিহাসের খাতা৷ কিন্তু তাতে করে আপনার চোখ অন্ধ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। মুদ্রার অপর পিঠ থেকে একবার হলেও ঘটনা বিশ্লেষণ করা উচিত৷ তাতে নিজের সিদ্ধান্ত নেয়ার কাজটি সহজ হয়৷
মেজর সিদ্দিক সালিক (পরবর্তীতে ব্রিগেডিয়ার) পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে একজন জনসংযোগ কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করেছেন৷ বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময় তিনি লেফটেনেন্ট জেনারেল নিয়াজীর সাথে সংযুক্ত ছিলেন৷ খবর রাখতেন বাইরের দুনিয়ার, ষড়যন্ত্র তথ্যগুলো তার কাছে আপনা আপনিই চলে আসতো৷ ফলে তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অন্যান্য অফিসার থেকে ছিলেন আলাদা ৷
বাংলাদেশের মানুষের বিরুদ্ধে পরিচালিত সকল কূটচালের চিত্র তিনি কাছ থেকে দেখেছেন৷ ঢাকা আগমনের পর থেকে বিদায়কালীন সময়ের মধ্যে তার সেনা জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা গুলোকে নিয়ে লিখলেন,“উইটনেস টু সারেন্ডার”৷
বইটি বাংলায় একাধিক অনুবাদ হয়েছে৷ সবুজপাতা প্রকাশনীর অনুবাদ সম্পাদনা করেছেন আজিজুল হক৷ হাতের কাছে বইটি পেয়েই লুফে নিলাম ৷ বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর পাকিস্তানি কোন সেনা কর্মকর্তার লেখা এটিই প্রথম বই৷ ১৯৭৭ সালে গ্রন্থটি প্রকাশের পরপরই এটিকে ঘিরে ব্যাপক আলোচনার সৃষ্টি হয়৷ উইটনেস টু সারেন্ডারকে সিদ্দিক সালিক তিন ভাগে বিভক্ত করেন।
১) রাজনৈতিক
২) সামরিক-রাজনৈতিক
৩) সামরিক
বইটির প্রথমভাগে অপারেশন সার্চলাইট এর পূর্ববর্তী বিষয়গুলো প্রাধান্য পায় ৷ রাজনৈতিক দোলাচল, সামরিক আইন এবং বঙ্গবন্ধুর ডি-ফ্যাক্টো সরকারের বিষয়গুলোর উপর আলোকপাত করা হয়।পাকিস্তান সেনাবাহিনীর চাপ,আমেরিকার চাপ এবং আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ চাপ ঠিক ভাবেই সামলে নেন বঙ্গবন্ধু ৷সিদ্দিক সালিক তার গ্রন্থে ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণকে কৌশলী হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন৷ তিনি সামরিক আইন প্রশাসকের বরাত দিয়ে বলেন,”এই পরিস্থিতিতে এটাই সবচেয়ে উত্তম ভাষণ।“
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডিফ্যাক্টো সরকারকে উচ্ছেদের জন্য জেনারেলরা ১৬ প্যারা সম্বলিত ০৫ পৃষ্ঠাব্যাপী একটি পরিকল্পনা করেন৷ পরিকল্পনার নাম দেয়া হয় “অপারেশন সার্চলাইট” ৷ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া করাচী পৌঁছানোর পর আনুষ্ঠানিকভাবে অপারেশন শুরু হয়৷ কিন্তু সেনারা ক্যান্টনমেন্ট থেকে বেরিয়ে ফার্মগেট এলাকায় প্রথম বাধার সম্মুখীন হন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তখনই স্বাধীনতার ঘোষণা দিলেন৷ সিদ্দিক সালিক এই বিষয়ে লিখেছেন,
“যখন প্রথম গুলিটি বর্ষিত হলো, ঠিক সেই মুহূর্তে পাকিস্তান রেডিওর সরকারি তরঙ্গের (ওয়েভ লেংথ) কাছাকাছি একটি তরঙ্গ থেকে শেখ মুজিবুর রহমানের কণ্ঠস্বর ভেসে এলো৷ওই কণ্ঠের বাণী মনে হলো আগেই রেকর্ড করে রাখা হয়েছিল৷ তাতে শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানকে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ হিসেবে ঘোষণা করলেন।”
শুরু হয়ে গেল ধ্বংসযজ্ঞ৷ ঢাকা শহরের নেতৃত্বে ছিলেন জেনারেল ফরমান আলী অন্যদিকে মেজর জেনারেল খাদিম কে দেয়া হয় সমগ্র দেশের দায়িত্ব৷ আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার করার জন্য অভিযান পরিচালিত হতে লাগলো৷ বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে ওয়ারল্যাসে বার্তা পাঠানো হলো,
"বড় পাখিটা খাঁচার ভেতর,,,,,,,,অন্যগুলো নীড়ে নেই,,,,,,,, ওভার"
অষ্টম ইস্ট বেঙ্গলের বাঙালি ব্রিগেডিয়ার মজুমদারকে চট্টগ্রাম থেকে কৌশলে ঢাকা এনেও শেষ রক্ষা হলো না ৷ সেখানে দ্বিতীয় ব্যক্তি মেজর জিয়াউর রহমান রেডিও ট্রান্সমিটার দখল করে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র প্রচার করে দেন৷ চট্টগ্রাম নিয়ে তখন ঢাকার উদ্বিগ্নতা বেড়ে যায়।
সমগ্রদেশের নিয়ন্ত্রণ নেয়ার জন্য সেনাবাহিনী ছড়িয়ে পড়ে এবং হত্যাযজ্ঞ চালায়৷ ঘটনাপ্রবাহে সেনাধ্যক্ষ,আঞ্চলিক সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে টিক্কা খান এর পরিবর্তে লে.জে. নিয়াজীকে নিয়ে আসা হয়৷তার চারিত্রিক দুর্বলতা ছিল৷ কমান্ড হস্তান্তরের সময় সে অন্য অফিসারের সাথে রক্ষিতা নিয়ে টিপ্পনি কাটতেও ছাড়েননি। পরবর্তীতে তার বাহিনী তার দেখানো পথেই হেঁটেছিল৷
সিদ্দিক সালিক এক বাঙালি সম্পাদকের বাড়িতে গেলেন৷ বৈঠকখানায় সম্পাদকের স্ত্রীর কাছে দাঙ্গা-হাঙ্গামা নিয়ে দুঃখ প্রকাশ করতেই ভদ্রমহিলা তার কথা কেড়ে নিলেন৷ বলে উঠলেন,
“অসংখ্য বাড়িঘর ধ্বংস করে,অসংখ্য মানুষ হত্যা করে, অসংখ্য নারী ধর্ষণ করে আপনি এখন দুঃখিত বলছেন৷ নিশ্চয়ই আপনি সেই পশুদের একজন,যারা গতরাতে আমার বোনের বাসায় গিয়েছিল।”
পাকিস্তানি সেনা বাহিনীর হত্যাযজ্ঞ এই বক্তব্যের মাধ্যমে অনেকটা স্পষ্ট হয়ে যায়৷
ওদিকে ভারতীয় সমর্থনে মুক্তিবাহিনী সংগঠিত হতে থাকে৷ এরকম সুযোগ দ্বিতীয়বার আসবে না বলে ভারত ধরে নেয়৷ প্রাথমিক পর্যায়ে মুক্তিবাহিনী সীমান্ত এলাকায় অপারেশন চালাতো৷ এরপর গেরিলারা বাংলাদেশের ভূখণ্ডের ভেতরে ছড়িয়ে পড়তে লাগলো।নিরপরাধ ও বেসামরিক লোকদের থেকে তাদের পৃথক করা কঠিন হয়ে পড়লো৷ বগলের নিচে স্টেনগান লুকিয়ে রাখা কৃষক হঠাৎ হয়ে উঠতো মুক্তিযোদ্ধা। মিলিটারির সহায়তার জন্য রাজাকার বাহিনী গড়ে ওঠে ৷ তারা অস্ত্র চালনায় দক্ষ না হলেও সেনাবাহিনীর প্রতি খুবই আন্তরিক ছিল এবং তারা আলাদা শক্তি হিসেবে বিবেচিত হতো৷
একজন দন্ত চিকিৎসক ডা. মালিককে গভর্নর করা হলো৷ বাঙালিরা তাকে বিশেষ পছন্দ করতেন না ৷ অবাঙালিরা তার উপর আস্থা রাখতে পারছিলোনা৷ জেনারেল নিয়াজী ০৩ ডিসেম্বর ৩০ জন সেনা অফিসারের সামনে আন্তর্জাতিক সীমান্ত অতিক্রমের অনুমোদন দেন৷ সেদিন সন্ধ্যার পূর্বে পাকিস্তান বিমান বাহিনী, ভারতীয় বিমান ঘাঁটিতে আঘাত হানে ৷ শুরু হয় সর্বাত্মক যুদ্ধ।প্রথম দিনেই ভারত দশ থেকে বারোটি বিমান হারিয়ে ফেলে৷ পরবর্তীতে ভারতীয় বাহিনী তাদের পরিকল্পনা বদলিয়ে ঢাকা বিমানবন্দর অকার্যকর করে দেয়৷ এতে পাকিস্তান বিমানবাহিনী মূলত অচল হয়ে পড়ে, তাদের নৌবাহিনীও ততটা কার্যকর ছিল না।
ভারতীয় বাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে যুদ্ধে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অপারেশনাল পরিস্থিতির আরো অবনতি ঘটতে লাগলো৷ ডিভিশনাল সেক্টরগুলো সাব-সেক্টরেে খন্ডিত হয়ে গেল। ভারত ২৫ কিলোমিটার শিলিগুড়ি করিডোর কে ৫৫ কিলোমিটার প্রশস্ত করে বাংলাদেশের অনেকটা দখল করে নিলো৷ সমগ্র রণাঙ্গনে পাকিস্তান সেনাবাহিনী পিছিয়ে পড়তে লাগলো। গভর্নর মালিক নিয়াজীকে ডেকে বললেন,
“একজন জেনারেলের জীবনেও উঠানামা আছে। যশ একসময় তাকে আচ্ছাদিত করে আরেক সময় পরাজয় তার মর্যাদাকে ধুলিস্যাৎ করে।”
জেনারেল নিয়াজী কান্নায় ভেঙে পড়েন৷ তখন থেকে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব নিয়ে দফায় দফায় রাওয়ালপিন্ডি ও ঢাকার মধ্যে চিঠি চালাচালি শুরু হয়ে যায়৷ অবশেষে ১৪ই ডিসেম্বর বিকাল ০৫:৩০ এ আত্মসমর্পণের ইঙ্গিতপুর্ণ টেলিগ্রাম ঢাকায় এসে পৌঁছায়৷ মিরপুর সেতু দিয়ে ভারতীয় মেজর জেনারেল নাগরা অগ্রসর হয়ে নিয়াজীকে লিখলেন,
“প্রিয় আব্দুল্লাহ আমি এসে গেছি”
বিমানবন্দর দিয়ে মেজর জেনারেল জ্যাকব আত্মসমর্পণের দলিল নিয়ে আসলেন৷ প্রায় ১০ লক্ষ বাঙালি এবং দেশি-বিদেশি সংবাদমাধ্যমের সামনে ভারতীয় পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের অধিনায়ক লেফটেনেন্ট জেনারেল অরোরা ও লেফটেনেন্ট জেনারেল নিয়াজী আত্মসমর্পনের দলিলে স্বাক্ষর করলেন।
এভাবেই ঢাকা পতনের বর্ণনা দিয়েছেন তৎকালীন মেজর সিদ্দিক সালিক।
“উইটনেস টু সারেন্ডার”গ্রন্থে তিনি উভয় পক্ষের বয়ান দিতে গিয়ে নিজেকে কিছুটা নিরপেক্ষ রাখতে চেয়েছেন৷ পাকিস্তানের রাজনৈতিক পটপরিবর্তন সম্পর্কে তার তীক্ষ্ণ নজর ছিল৷ তিনি ঢাকায় এসেই বুঝতে পেরেছিলেন পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে মানসিক ক্ষেত্রে পুরোপুরি বিচ্ছেদ ঘটে গেছে।
বইটিতে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ভুলভাবে কিছু জায়গায় চিত্রিত করা হয়েছে।কয়েকটি স্থানে তাকে দ্বৈত আচরণের মানুষ হিসেবে প্রমাণ করার চেষ্টা চালানো হয়েছে এবং এক জায়গায় তিনি লিখেছেন,
“ঢাকায় ইয়াহিয়ার একজন প্রতিনিধি ঘরোয়াভাবে মুজিবকে একটা বিষয়ের উপর প্রশ্ন করেছিলেন, মুজিব অস্বীকার করলেন এটা তার সর্ব প্রথম রাজনৈতিক ডিগবাজি ছিল না কিংবা সর্বশেষ নয়৷ দেখা গেছে জনসমক্ষে তিনি হাজির হয়েছেন ভয়াবহ চেহারায় কিন্তু ঘরে ফিরে গিয়ে পরিণত হয়েছেন একজন শান্তশিষ্ট মানুষে।”
মুক্তিবাহিনী সম্পর্কেও তিনি কিছুটা জলঘোলা করতে চেয়েছেন ৷ অবাঙ্গালীদের উপর অত্যাচারের কাহিনী অনেকটা মর্মভেদী করে তুলে ধরেছেন।
বইয়ের সামরিক অংশটুকু আমাকে কিছুটা বিরক্ত করে তুলেছিল হয়তো সৈনিকদের কাছে যুদ্ধক্ষেত্রের বর্ণনাগুলো অনেক গুরুত্ব বহন করবে। আমার কাছে মনে হয়েছে বইটির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ অপারেশন সার্চলাইট,চূড়ান্ত পশ্চাৎপসরণ এবং আত্মসমর্পণের বিষয়গুলো। কারণ এসব বিষয়ের বর্ণনা তিনি বিশদভাবে তুলে ধরেছেন ৷ বাংলা অনুবাদে বানান রাক্ষসের জন্য প্রকাশনীকে কথা শুনতে হবে ৷ অনুবাদে কিছু জায়গায় সাবলীলতা ছিলোনা৷
পাকিস্তানি সেনা ছাউনিতে বসে মুক্তিযুদ্ধকে দেখতে চাইলে খুব দ্রুতই পড়ে ফেলুন সিদ্দিক সালিকের “উইটনেস টু সারেন্ডার”
Comments (0)