২০২০: কেবল কোভিডের নয়, বিজ্ঞানেরও বছর

একবিংশ শতাব্দীর নানা দিক থেকে তাৎপর্যময় বছর হিসেবে ২০২০ সালকে আমাদের প্রজন্ম বেশ ভাল করে মনে রাখবে। মহামারীর বিষে বিষাদময় বছরটি ইতিহাসের পাতায় থাকবে প্রাণসংহারী পরিচয়ে। প্রকৃতির সাথে অনবরত যুদ্ধে মানবসভ্যতার এ চলাকে থমকে দেওয়া কোভিড-১৯ সংক্রমণ আমাদের করেছে শক্তিশালী। অভিযোজন ক্ষমতার বৈশিষ্ট্যের কারণে মানুষ অন্যন্য প্রাণী হলেও কেবল কোভিড-১৯ সংক্রমণে অ্যাডাপটেশন বেশ বেদনাদায়ক। জন্ম দিয়ে অনাকাংক্ষিত অনেক ঘটনার।

বছর জুড়ে দেশে দেশে মানুষ মরার মিছিল যখন সমগ্র জাতির রাষ্ট্র প্রধানদের ভাবিয়ে তুলছে, মানবজাতির এ দুর্দিনে ত্রাতা হিসেবে বরাবরের মত এগিয়ে এসেছে বিজ্ঞান। বিজ্ঞানীদের সীমাহীন প্রচেষ্টায় কোভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণের কৌশল উদ্ভাবনের এ সম্মুখ যুদ্ধে শতশত গবেষক নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছেন।

পৃথিবীতে বিভিন্ন সময় মহামারী এসেছে, ব্যাপক প্রাণহানির ঘটনাও ঘটেছে। বছরের পর বছর ধরে এই প্রাণ সংহার চললেও বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবনে সংক্রমণের দফারফা হয়েছে। সেটাও ছিল সময় সাপেক্ষ ব্যাপার।

কিন্তু করোনাভাইরাস সার্স-কভ-২ সংক্রমণ ঠেকাতে আমাদের সহকর্মীদের গবেষণার ফসল আমরা যেভাবে পেয়েছি, তা অন্যন্য সময়ের ফ্রেমে কিছুটা ভিন্ন। দ্রুততম সময়ে কোভিড-১৯ মোকাবেলা করতে নেমে পড়া গবেষকদের মৌলিক দায়বদ্ধতার জায়গাটি স্পষ্ট হয়েছে। 

আমি যদি ভুল না করে থাকি, করোনাভাইরাস নিয়ে বাংলাদেশের গণমাধ্যমে সর্ব প্রথম নিউজটি এসেছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে। (সূত্র-১)। ২০২০ এর জানুয়ারিতে ওই সংবাদটি যখন লিখছিলাম, তখন কখনোই ভাইরাসটি এতোটা প্রাণসংহারী হয়ে উঠবে ভাবিনি। কেবল দেশে গণ-সচেতনতা তৈরি করার জন্য এই প্রতিবেদনটি করা হয়েছিল।

নতুন ধরনের ভাইরাসটি মোকাবেলা করতে আমাদের অভিজ্ঞতায় ছিল অপরিপক্কতা। শুরুতে সরকার বিষয়টিকে তেমন গুরুত্ব দেয়নি। দেশের কিছু আলেম সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভ্রান্তিমূলক বক্তব্যে দিয়ে বুঝিয়েছিলেন করোনাভাইরাস বলে কিছু নেই। ভ্যাকসিন নিয়ে তারা করেছিল বেশ ঠাট্টা। সোশাল মিডিয়া ও গণমাধ্যমে চলা নানা ধরনের ‘হোক্স’ বা প্রচারণার কারণেই দেশের নীতি নির্ধারকরাও করোনাভাইরাসের সংক্রমণের গুরুত্ব বুঝতে ব্যর্থ হয়েছিলেন।

আমাদের দেশে যখন করোনাভাইরাস নিয়ে আমরা হাসি-মশকরা করে দিন পার করছিলাম, ঠিক তখন কিছু বিজ্ঞানী সত্যি দেবদূতের মত কাজ করে যাচ্ছিলেন নতুন ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে।  

চীনের উহানে সংক্রমণের কয়েকদিনের মধ্যে নতুন আসে চীনের সাংহাই পাবলিক হেলথ ক্লিনিকাল সেন্টার ও স্কুল অব পাবলিক হেলথ, হুয়াজং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, ওহান সেন্ট্রাল হাসপাতালের রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধের কেন্দ্র, চীনের কেন্দ্রিয় রোগ নিয়ন্ত্রণ দপ্তর এবং অস্ট্রেলিয়ার সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌথ সহযোগিতায় এই ভাইরাসটির জীবন রহস্য উম্মোচণ করা হয় (সূত্র-২)। ১১ জানুয়ারি প্রকাশিত এ ডেটায় প্রায় ৩০ হাজার নিউক্লিউটাইডের এই সিকোয়েন্স পাওয়ার পর সারা বিশ্বের গবেষকরা তা নিয়ে গবেষণা করতে শুরু করে।

জানুয়ারির মাসের মধ্যে প্রায় ৫৪টি গবেষণাপত্র চিকিৎসা সাময়িকী ল্যানসেট, নেচার, সায়েন্স, বায়োর্কাভ এর জার্নালগুলোতে প্রকাশ হতে থাকে। 

প্রথম দিকে গবেষণায় ভাইরাসটিকে এনকভ-২০১৯ বলা হলেও, পরিবর্ততে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এর নামকরণ করে ‘সিভিয়ার অ্যাকিউট রেসপাইরেটরি সিনড্রোম করোনাভাইরাস টু’ বা সংক্ষেপে সার্স-কোভ-২ নামে । ২০০৩ সালে চীনের গুয়াংডু প্রদেশে মহামারী আকারে রূপ নেওয়া করোনাভাইরাসের জিনোম সিকোয়েন্সের সাথে প্রায় ৭৯ শতাংশ মিল পাওয়া যাওয়ায় এ আরএনএ-র নামকরণ গবেষকরা গ্রহণ করে গবেষণা শুরু করে দেয়।

এর মধ্যে ফেব্রুয়ারিতে করোনাভাইরাসের বৈশিষ্ট্য ও নানান দিক আলোচনা করা হয়  চিকিৎসা বিজ্ঞানের অন্যতম সেরা সাময়িকী দ্য নিউ ইংল্যাণ্ড জার্নাল অব মেডিসিনে- A Novel Coronavirus from Patients with Pneumonia in China, 2019 শিরোনামে প্রকাশিত গবেষণাপত্রে। (সূত্র-৩) করোনাভাইরাসের লক্ষণ ও সংক্রমণের বিশদ আলোচনা উঠে আসে এ গবেষণাপত্রটি থেকে।

বিজ্ঞানীরা খুঁজতে থাকলেন করোনাভাইরাসের কোন প্রজাতির সাথে এর সংক্রমণ বৈশিষ্ট্য মিল পাওয়া যাচ্ছে। করোনাভাইরাসের তথ্য অনুসন্ধান করতে গিয়ে দেখা গেল এটি করোনাভিরিডি পরিবারের করোনাভিরিনে গোত্রের অন্তগর্ত। আলফা, বেটা, গামা ও ডেল্টা করোনাভাইরাসের মধ্যে আলফাকরোনাভাইরাস এবং বিটাকরোনাভাইরাসগুলি কেবল স্তন্যপায়ীকে সংক্রামিত করে আর গ্যামাকরোনাভাইরাস এবং ডেল্টাকরোনাভাইরাস কেবল পাখিকে সংক্রামিত করতে পারে।

ভাইরাসটি শনাক্তকরণের কৌশল নির্ধারণ করতে বিজ্ঞানীদের বেগ পেতে তেমন হয়নি। চিরায়িত পদ্ধতিগুলোর মধ্যে গোল্ড স্টান্ডার্ড হিসেবে পরিচিত রিভার্স-ট্রান্সক্রিপেটেজ পলিমারেজ চেইন রিয়্যাকশন বা আরটিপিসিআর মাধ্যমে যে বিভিন্ন প্রজাতি আরএনএ সিকোয়েন্স জানার কৌশলটিকে কাজে লাগানো হয়। যে পদ্ধতিটি সারা বিশ্বের রাষ্ট্রগুলো করোনাভাইরাস সার্স-কভ-২ শনাক্তকরণ করে যাচ্ছে।  

এরপর গবেষকরা দেখতে পেলেন, নতুন এ ভাইরাসটি কোন প্রাণী থেকে কোন প্রাণীতে ছড়াচ্ছে এবং ঠিক কোন মেকানিজম মেনে  মানুষের দেহে প্রবেশ করছে তা নিয়ে গবেষণা শুরু করলেন।  

করোনাভাইরাসের বেশ কয়েকটি সংক্রমণশীল অংশ রয়েছে। এদের মধ্যে অন্যতম হলো স্পাইক প্রোটিন, যা মানবদেহের চামড়ার নিচে থাকা angiotensin-converting enzyme 2 (ACE2) গ্রাহকের উপর লেগে থাকে। এবং স্পাইক প্রোটিনটি শরীরে প্রবেশ করে সংক্রমণ ঘটায়। ঠিক এই তথ্যটি পাওয়া গিয়েছিল জার্মানির গজেন বিশ্ববিদ্যালয়ের  একদল গবেষকদের SARS-CoV-2 Cell Entry Depends on ACE2 andTMPRSS2 and Is Blocked by a Clinically ProvenProtease Inhibitor শিরোনামে বিজ্ঞান সাময়িকী ‘সেল’ (সূত্র-৪)  প্রকাশিত গবেষণাটিতে।

এ তথ্যটি ওষুধ ও ভ্যাকসিন তৈরি করার ক্ষেত্রে শক্তিশালী ভূমিকা পালন করেছিল। পরবর্তীতে বিজ্ঞানীরা ভাইরাসটির ইলেকট্রন মাইক্রোসকপির ছবি ও এসিই২ রিসেপ্টরের তৃতীয়মাত্রার চিত্র পেয়ে যায়। স্পাইক প্রোটিনের ঠিক কোন অংশ অথাৎ ডিএনএ সিকোয়েন্সের নিউক্লিউটাইডগুলো আঁকড়ে ধরছে তার বিশদ তথ্য আমরা বেশ কিছু গবেষণায় পেয়ে গিয়েছিলাম। যেগুলো পরবর্তী গবেষণায় অগ্রণী ভূমিকা রাখে।

ঠিক এ তথ্যগুলো পাওয়ার পর সারা বিশ্ব থেকে ২৩৩টি ভ্যাকসিন তৈরির গবেষণা শুরু হয় (সূত্র-৫)। যার মধ্যে ৬১ টি ক্লিনিক্যাল ফেইজ ২/৩ রয়েছে। 

Posted in Education Blogs on December 30 2020 at 02:43 PM

Comments (0)

No login
color_lens
gif