বাংলাদেশের অব্যাহত অগ্রযাত্রায় নারীর অবদান উল্লেখযোগ্য। কৃষির উন্নয়ন ছাড়া জাতীয় উন্নয়ন সম্ভব নয়। আদি পেশা কৃষির সূচনা হয় নারীর হাত ধরেই। ঘরের কাজের পাশাপাশি তারা কৃষিকাজও করে আসছে বহুকাল থেকে। গ্রামীণ সমাজে পুরুষরাই মাঠে কৃষিকাজ করে এবং নারীরা রান্নাবান্না আর সন্তান লালনপালন নিয়েই ব্যস্ত থাকছে। বর্তমানে প্রত্যক্ষভাবে কৃষিকাজে এগিয়ে এসেছে নারীরা। তারা পুরুষের সঙ্গে সমান তালে এগিয়ে যাচ্ছে। খাদ্য নিরাপত্তা, কৃষি উৎপাদন বিশেষ করে রবিশস্য উৎপাদন, গবাদি পশু ও হাঁস-মুরগি পালন, সবজি ও মৎস্য চাষ, বনায়ন এসব কাজে নারীরা পুরুষের পাশাপাশি সমান অবদান রাখছে।
ফসলের ক্ষেতে ধানের বীজ বপন করা থেকে শুরু করে সার দেয়া, আগাছা দমন, কীটনাশক ছিটানো, ধান কেটে ঘরে তোলাসহ সব কাজই নারীরা করছে। অনেকেই আবার বাড়ির পাশে কিংবা উঠানে অনাবাদি জায়গায় শাকসবজি, ফলফলাদির আবাদ করে সংসারে বাড়তি রোজগারের পথ করে নিচ্ছে। এতে পরিবারের খরচ মিটানোর পাশাপাশি দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতেও তাদের অবদান বাড়ছে।
দেশের একটি সমৃদ্ধ খাত চা-শিল্প। এখানে পাহাড়ি নারী চা শ্রমিকদের অবদান অনস্বীকার্য। এ ছাড়া দক্ষিণাঞ্চলে চিংড়ি চাষ, হাঁস-মুরগি পালন থেকে শুরু করে আজকে কৃষির প্রায় সব ক্ষেত্রেই নারীর অবদান বাড়ছে। গবেষণায় দেখা গেছে, কৃষি উৎপাদন বাড়ানোর জন্য কৃষি সম্প্রসারণ সেবা কার্যক্রমের আওতায় উদ্ভাবিত নতুন প্রযুক্তি ব্যবহারে নারীরা অত্যন্ত নিষ্ঠা ও দক্ষতার পরিচয় দিচ্ছে।
দেশের মোট শ্রমশক্তির উল্লেখযোগ্য একটি অংশ নারী। নারী শ্রমশক্তির মধ্যে ৬৮ শতাংশই কৃষি, বনায়ন ও মৎস্য খাতের সঙ্গে জড়িত। কর্মক্ষম নারীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি নিয়োজিত রয়েছেন কৃষিকাজে। বলা চলে, কৃষি ও এর উপখাতের মূল চালিকাশক্তি নারী। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক কোনো পরিসংখ্যানে নারীর এ উপস্থিতির হিসাব নেই। এমনকি কৃষিকাজে জড়িত বিপুলসংখ্যক নারী শ্রমিকের কোনো মূল্যায়নও করা হয় না। এখনও গ্রামীণ সমাজে কৃষি ও চাষের কাজকে নারীর প্রতিদিনের কাজের অংশ বলে বিবেচনা করা হয়। সেখানে মজুরি প্রদানের বিষয়টি অবান্তর। কোনো কোনো ক্ষেত্রে নামমাত্র মজুরি দেয়া হয়।
কৃষিতে নারী শ্রমিকের সংখ্যা ক্রমবর্ধমান। কৃষি খাতে নিয়োজিত পুরুষের চেয়ে নারীর অবদান ৬০ থেকে ৬৫ শতাংশ বেশি। দেশে গত এক দশকে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত প্রায় এক কোটি ৩০ লাখ বাড়তি শ্রমশক্তির ৫০ লাখই নারী শ্রমিক। বর্তমানে প্রায় এক কোটি ২০ লাখ নারী শ্রমিকের ৭৭ শতাংশই গ্রামীণ নারী। এ সময়ে দেশে কৃষি, বন ও মৎস্য খাত এবং পশু ও হাঁস-মুরগি পালন প্রভৃতি কাজে নিয়োজিত নারী শ্রমিকের সংখ্যা ৩৭ লাখ থেকে বেড়ে প্রায় ৮০ লাখ হয়েছে। এ বৃদ্ধির হার ১১৬ শতাংশ। যদিও এসব নারী শ্রমিকের ৭২ শতাংশই অবৈতনিক পারিবারিক শ্রমিক।
বর্তমানে পেশা বদলের কারণে কৃষি, বন ও মৎস্য খাতে পুরুষ শ্রমিকের অংশগ্রহণ কমেছে ১০ দশমিক চার শতাংশ। ফসলের বপন প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে ফসল উত্তোলন, বীজ সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াকরণ এমনকি বিপণন পর্যন্ত বেশিরভাগ কাজ নারী এককভাবেই করে। কৃষি ও এর উপখাতের মূল চালিকাশক্তি হচ্ছে নারী। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক কোনো পরিসংখ্যানে নারীর এ উপস্থিতির কোনো হিসাবে স্বীকৃতি নেই। এমনকি কৃষিকাজে জড়িত এ বিপুলসংখ্যক নারী শ্রমিকের তেমন কোনো মূল্যায়নও করা হয় না।
নারীরা এখনও বিভিন্নভাবে বৈষ্যমের শিকার হচ্ছে। কৃষি উপকরণ, সারবীজ, কৃষক কার্ড ও ঋণের বেশিরভাগ সুবিধা পুরুষ কৃষক পান বলে অভিযোগ রয়েছে। এখনও গ্রামীণ সমাজে কৃষি ও চাষের কাজকে নারীর প্রাত্যহিত কাজের অংশ বলে বিবেচনা করা হয়। ভূমির মালিকানা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পুরুষের হাতে। ফসল উৎপাদনের ২১টি ধাপের ১৭টিতেই নারীর সরাসরি অংশগ্রহণ রয়েছে।
দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির জন্য কৃষিতে নারী শ্রমিকের অবদানের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি অত্যন্ত জরুরি বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। গ্রামীণ নারীর শ্রম নির্ঘণ্ট শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী ১৫ থেকে ৬০ বছর বয়সী যারা কাজের সঙ্গে জড়িত, অথবা কাজ করছে না কিন্তু কাজ খুঁজছে, এমন জনগোষ্ঠীকে শ্রমশক্তি হিসেবে ধরা হয়। সরকারি তথ্যানুযায়ী, গত এক দশকে প্রায় এক কোটি ৩০ লাখ নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে কৃষি, বন ও মৎস্য খাতেই যুক্ত হয়েছে প্রায় ৫০ লাখ কর্মসংস্থান। শ্রমশক্তির হিসাব অনুযায়ী ৩০ শতাংশ নারী কেবল শ্রমশক্তির অংশ হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছে। এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ৮১ শতাংশ নারী গৃহকর্মে সরাসরি অবদান রাখছে। তাদের বিরাট অংশ কৃষানি, কিন্তু শ্রমশক্তির বিবেচনায় তা যথাযথভাবে উঠে আসছে না।
নারী কৃষি শ্রমিকদের শ্রম আইনে অন্তর্ভুক্ত করে কৃষক হিসেবে তার প্রাপ্য সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে পারলে দেশের সার্বিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে। কৃষকের অধিকার আদায়ে কৃষিশ্রম আইন প্রতিষ্ঠাসহ একটি কৃষি কমিশনও গঠন করা জরুরি। আইন প্রণয়ন এবং এর সফল বাস্তবায়নের মাধ্যমেই কেবল টেকসই কৃষি উন্নয়ন সম্ভব। ফলে কৃষক ও কৃষি শ্রমিক উভয়েরই স্বার্থ রক্ষা সম্ভব। নারী কৃষি শ্রমিকদের নিবন্ধন ও পরিচয়পত্র দান, একই ধরনের কাজে পুরুষের সমান মজুরি নিশ্চিত করা, সরকারি কৃষি কর্মকাণ্ডে নারীদের অগ্রাধিকার দেয়া, কৃষিকাজে নারী শ্রমিকদের পেশাগত স্বাস্থ্য নিশ্চিত করা, প্রান্তিক সুবিধাদি ও সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে নারী কৃষি শ্রমিক তথা কৃষানিদের অগ্রাধিকার দেয়াসহ আরও বেশকিছু পদক্ষেপ নিলে উন্নয়নের পথ সুগম হবে।
‘জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি, ২০১১’-তে মোট তিনটি ভাগে ৪৯টি অধ্যায় রয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে ১৬ দশমিক এক বাংলাদেশ সংবিধানের আলোকে রাষ্ট্রীয় ও জনজীবনের সব ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা করা, ১৬ দশমিক ৯ সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিমণ্ডলে নারীর অবদানের যথাযথ স্বীকৃতি প্রদান করা, ২৩ দশমিক পাঁচ সম্পদ, কর্মসংস্থান, বাজার ও ব্যবসায় নারীকে সমান সুযোগ ও অংশীদারিত্ব দেয়া, ২৩ দশমিক ১০ জাতীয় উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে কৃষি ও গার্হস্থ্য শ্রমসহ সব নারীশ্রমের স্বীকৃতি প্রদান করা, ৩১ দশমিক তিন কৃষিতে নারী শ্রমিকের মজুরি বৈষম্য দূরীকরণ এবং সমকাজে সমমজুরি নিশ্চিত করার উদ্যোগ গ্রহণ করা। এসব ধারা যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হলে কৃষি নারী শ্রমিকদের অধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত হবে, এ কথা জোর দিয়ে বলা যায়। শুধু তা-ই নয়, নারীর ভাগ্যোন্নয়ন হলে নারীরা এ দেশের কৃষি উন্নয়নসহ অন্য উন্নয়ন সমৃদ্ধিকে আরও বেগবান করতে পারবে।
বর্তমান সরকার নারী ও কৃষিবান্ধব সরকার। নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন জোরদারে সরকারের খাসজমি বিতরণ এবং ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ঋণ প্রাপ্তিতে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সরকার নারী কৃষানি কার্ড প্রবর্তন করেছে। একই সঙ্গে নারী কৃষকরা যাতে বিনা জামানতে কৃষি খাতে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিতে পারে এবং সরকারি খাসজমি বিতরণে যাতে অগ্রাধিকার পায় সেজন্য সরকার প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেবে। কৃষি উন্নয়ন ও কৃষি অর্থনীতিকে টিকিয়ে রাখার লক্ষ্যে নারী কৃষি শ্রমিকের অধিকার প্রতিষ্ঠায় অগ্রাধিকার দিয়েছে সরকার। দারিদ্র্য দূরীকরণ এবং মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হতে হলে অবশ্যই নারীর প্রতি বৈষম্যহীন সব উন্নয়ন ধারা নিশ্চিত করতে হবে। বাংলাদেশ সংবিধানে ২৮ নং অনুচ্ছেদে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সব নাগরিকের সমান অধিকারের নিশ্চয়তার কথা বলা হয়েছে। এ লক্ষ্যেই নারীর সম-অধিকার ও সমমূল্যায়নের বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। তবে এ বিষয়ে সরকারের পাশাপাশি সবার সচেতনতা দরকার।
সমাজ তথা রাষ্ট্রে নারীর ক্ষমতায়নে নারীর কাজের সামাজিক ও আর্থিক স্বীকৃতি আবশ্যক। কৃষিনির্ভর অর্থনীতির দেশে কৃষিকে যেমন উপেক্ষা করা যায় না, তেমনি এ খাতে নারীর অবদানও আজ অস্বীকার করার উপায় নেই। কৃষি খাতে নিয়োজিত নারী শ্রমিকের স্বীকৃতি ও ন্যায্য মজুরি প্রদান নিশ্চিত করতে পারলে দেশের কৃষি উৎপাদন কাজে নারীরা আরও আগ্রহী হবে। ফলে কৃষি খাতের উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে এবং জিডিপিতে কৃষির অবদানও বাড়বে বলে আশা করা যায়।
Comments (0)