বাংলাদেশের ওপর ভূরাজনৈতিক চাপ বাড়বে

 
 
 
 
মিয়ানমারে সেনা অভ্যুত্থানের পর এখন তিনটি প্রশ্নই সবার কাছে বিবেচ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রথমত, এই সেনা অভ্যুত্থানের ব্যাপারে আন্তর্জাতিক সমাজের প্রতিক্রিয়া কী হবে; দ্বিতীয়ত, এ অভ্যুত্থান আঞ্চলিক রাজনীতিতে কী প্রভাব ফেলবে; তৃতীয়ত, এতে বাংলাদেশের সঙ্গে মিয়ানমারের সম্পর্কে কোনো পরিবর্তন ঘটবে কি না, বিশেষত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের অগ্রগতি বা অবনতি হবে কি না।
 
মিয়ানমারে সেনা অভ্যুত্থানের ঘটনা অনাকাঙ্ক্ষিত হলেও তা অনুমানের বাইরে ছিল না, নভেম্বরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে অং সান সু চির নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসির (এনএলডি) ব্যাপক বিজয়ের পর সেনাবাহিনীর প্রতিক্রিয়া থেকেই বোঝা যাচ্ছিল যে তারা এতে অসন্তুষ্ট। নির্বাচনে সেনাবাহিনী সমর্থিত রাজনৈতিক দল ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টির (ইউএসডিপি) ফলাফল এতটাই খারাপ হয়, যাতে এটা স্পষ্ট যে সংসদে সেনাবাহিনীর প্রভাব ও ক্ষমতা হ্রাস হবে। সংসদে সেনাবাহিনীর জন্য ২৫ শতাংশ আসন সংরক্ষিত থাকা এবং তিনটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়—প্রতিরক্ষা, স্বরাষ্ট্র এবং সীমান্ত—তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকলেও এনএলডির জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি সেনাবাহিনীকে উদ্বিগ্ন করেছে। কেননা, নাগরিকদের মধ্যে অং সান সু চির জনপ্রিয়তা দীর্ঘ মেয়াদে বিপদাপন্ন করতে পারে বলে তাদের মধ্যে ধারণা তৈরি হয়।
 
এর অন্যতম কারণ হচ্ছে, এত দিন ধরে বামার জাতীয়তাবাদের যে ধারাটি, বিশেষত উগ্র ধারাটি, সেনাবাহিনীকে তাদের আশ্রয়দাতা বলে বিবেচনা করে আসছিল, তারা এখন সু চি এবং তাঁর দলকে তাদের প্রতিনিধি বলে ভাবতে শুরু করেছে। আরাকানে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে অভিযান, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে ব্যক্তিগতভাবে উপস্থিত হয়ে সু চির বক্তব্য সু চিকে তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তুলেছে। এনএলডি এবং সু চির এ জনপ্রিয়তা সেনাবাহিনীর জন্য প্রীতিকর নয়। যদিও গত পাঁচ বছর সু চি সেনাবাহিনীর কথাই শুনে এসেছেন। গণহত্যার ব্যাপারে তাঁর অবস্থান এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ।
 
এনএলডি, বিশেষ করে সু চির এ ধরনের ভূমিকা অংশগ্রহণমূলক শাসন, গণতন্ত্র এবং সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার বিরুদ্ধে। তা ছাড়া এ নির্বাচনে সবার অংশগ্রহণও ছিল না, বেশ কিছু এলাকায় সহিংসতার অজুহাতে নির্বাচন হয়নি, রোহিঙ্গাদের তো ভোটাধিকারই নেই। কিন্তু নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে হয়নি বলে ইউএসডিপি যেসব অভিযোগ করছিল, সেগুলো এ কারণে নয়, তা আসলে সেনাবাহিনীরই অভিযোগ ছিল।
 
গত সপ্তাহে আন্তর্জাতিক সমাজের প্রতিনিধিরা সেনাবাহিনীকে ক্ষমতা গ্রহণ না করার ব্যাপারে হুঁশিয়ার করে দিয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেনাবাহিনী তা বিবেচনায় নেয়নি। সেনাবাহিনীর প্রধান হিসেবে মিন অং হ্লাইংয়ের অবসর গ্রহণের সময় ঘনিয়ে আসার কারণে তাঁর ব্যক্তিগত রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক আকাঙ্ক্ষার কথা বিবেচনা করলে ক্ষমতা গ্রহণের বিষয়টি একেবারে বিস্ময়কর মনে হবে না।
 
এ অভ্যুত্থানের পর আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া যা হয়েছে, তা পূর্ব ধারণা থেকে ভিন্ন কিছু নয়। চীন প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় বলেছে যে তারা প্রতিবেশী দেশে কী ঘটছে, তার দিকে ‘লক্ষ রাখছে’। চীনা বার্তা সংস্থা সিনহুয়া সামরিক অভ্যুত্থানকে বলেছে, ‘মন্ত্রিসভায় রদবদল’। পশ্চিমা দেশগুলোর পক্ষ থেকে অভ্যুত্থানের ব্যাপক সমালোচনা করা হয়েছে। ইতিমধ্যে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের রুদ্ধদ্বার বৈঠক হয়েছে। কিন্তু চীন ও রাশিয়ার কারণে একটি সম্মিলিত বিবৃতি দেওয়া সম্ভব হয়নি। জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন যে ভিন্নমতের মানুষের বিরুদ্ধে সহিংসতা চালানো হতে পারে, ইতিমধ্যে আটক ব্যক্তিদের মুক্তি চাওয়া হয়েছে।
 
মিয়ানমারে চীনের প্রভাব হ্রাস করার বিবেচনাকে প্রাধান্য দেওয়ার কারণে পশ্চিমা দেশগুলো ক্রমান্বয়ে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়। এ নীতির ফল যে ভালো হয়নি, সেটা ২০১৭ সালে এসে রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যা চালানোর মধ্যেই প্রমাণিত। তা সত্ত্বেও ইউরোপীয় ইউনিয়ন এ নির্বাচনেও সহযোগিতা করেছে।
এ প্রতিক্রিয়া জানানোর ক্ষেত্রে সংগত কারণেই পশ্চিমা দেশগুলো নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে ‘গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে’ ব্যাহত করার দিকটিকেই প্রাধান্য দিচ্ছে। ২০১৭ সালে রাখাইন প্রদেশে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীর চালানো ‘গণহত্যা’কে কেন্দ্র করে পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে অং সান সু চির সরকার এবং সেনাবাহিনীর টানাপোড়েন ছিল। তা সত্ত্বেও এখন সু চিকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেওয়ার পর পশ্চিমাদের এ প্রতিক্রিয়াকে অনেকেই হয়তো একে পশ্চিমাদের দ্বিমুখী নীতি বলেই সমালোচনা করবেন।
 
মিয়ানমারের রাজনীতি যাঁরা অনুসরণ করেন, তাঁরা জানেন যে পাঁচ দশকের বেশি সময় ধরে চলা সেনাশাসনের অবসানে ২০১১ সালে গণতন্ত্রায়ণের সূচনা হলেও মিয়ানমারে গণতন্ত্র আসেনি। ক্ষমতার ওপরে সেনাবাহিনীর সাংবিধানিক এবং সংবিধানবহির্ভূত প্রভাব, নাগরিকদের অধিকার সীমিতকরণ, গণমাধ্যমের স্বাধীনতার অভাব, সর্বোপরি রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যা চালানো—সবই প্রমাণ করে যে মিয়ানমারে বড়জোর ‘দো–আঁশলা শাসন’ জারি ছিল বা মিয়ানমার স্বৈরতন্ত্র থেকে হাইব্রিড রেজিমে পরিণত হয়েছিল। হাইব্রিড রেজিমে গণতন্ত্রের খোলস থাকে, কিন্তু নাগরিকেরা কার্যত কর্তৃত্ববাদী শাসনের জাঁতাকলে পিষ্ট হয়। মিয়ানমারে চীনের প্রভাব হ্রাস করার বিবেচনাকে প্রাধান্য দেওয়ার কারণে পশ্চিমা দেশগুলো ক্রমান্বয়ে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়। এ নীতির ফল যে ভালো হয়নি, সেটা ২০১৭ সালে এসে রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যা চালানোর মধ্যেই প্রমাণিত। তা সত্ত্বেও ইউরোপীয় ইউনিয়ন এ নির্বাচনেও সহযোগিতা করেছে।
 
২০১৭ সালের পর থেকে সারা বিশ্বে অং সান সু চি নিন্দিত হওয়া এবং পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে সু চির সম্পর্কের মারাত্মক অবনতির কারণে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ধরে নিয়েছে যে তাদের এ ক্ষমতা গ্রহণ তাদের বিশ্বব্যাপী বিরূপ জনমতের এবং চাপের মুখে ফেলবে না। তদুপরি, যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিস্থিতি, ক্ষমতায় নতুন প্রশাসন আসার ফলে যুক্তরাষ্ট্র খুব বেশি কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারবে না বলেই তারা ধারণা করে। চীনের সঙ্গে পশ্চিমাদের যে মতবিরোধ আছে, তা তাদের ঢাল হিসেবে কাজে দেবে। এসব বিবেচনা একেবারে আকাশকুসুম কল্পনা নয়। কিন্তু পশ্চিমা বিশ্বের প্রতিক্রিয়া কেবল এই সব দিয়েই প্রভাবিত হবে তা নয়। চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব মোকাবিলার একটি ফ্রন্ট হিসেবে মিয়ানমার ব্যবহৃত হবে না, তা নিশ্চিত করে বলা মুশকিল। চীনও সম্ভবত সেটাই চায়। এতে অন্যত্র চীন তার প্রভাব বিস্তারের বিষয় অব্যাহত রাখতে সক্ষম হবে।
 
যদিও চীন অং সান সু চি সরকারের প্রতি নাখোশ ছিল না, কিন্তু মিয়ানমারের সঙ্গে চীনের সম্পর্কের ভিত্তি হচ্ছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী, রাজনৈতিক দল নয়। গণতন্ত্রায়ণের সামান্য বাতাবরণ চীনের বাণিজ্যিক এবং কৌশলগত স্বার্থের ক্ষেত্রে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সুযোগ তৈরি করে দিয়েছিল। চীনের জন্য তা খুব স্বস্তিকর হয়নি। বিশেষ করে, মিয়ানমারে ভারতের বাণিজ্যিক উপস্থিতি এবং ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে সখ্য সাম্প্রতিক কালে চীনের জন্য প্রীতিকর নয়। ভারতের পক্ষ থেকে গত কয়েক বছরে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়েছে, কিন্তু সেটি অবশ্যই চীনের সঙ্গে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সম্পর্কের বিকল্প হতে পারে না। সেনাবাহিনী ক্ষমতা গ্রহণের ফলে যে চাপের মধ্যে পড়বে, তাতে চীনের সঙ্গে তার সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতা আরও বাড়বে। তার প্রতিক্রিয়া দক্ষিণ এশিয়ায় পড়বে।
 
মিয়ানমারে চীনের প্রভাব নিরঙ্কুশ হওয়ার কারণে ভারত দক্ষিণ এশিয়ায় তার প্রভাববলয়কে আরও জোরদার করতে চাইবে, সেটাই স্বাভাবিক। তার পরিণতি হিসেবে মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী দেশ হিসেবে বাংলাদেশের ওপর চাপ বাড়বে বলেই অনুমান করা যায়। চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক কালে সম্পর্ক নিয়ে, তার মাত্রা যা–ই হোক না কেন, ভারতের অস্বস্তি ইতিমধ্যেই প্রকাশিত হয়েছে। মিয়ানমারের পরিস্থিতি চীনকে যতটা সুবিধা দিয়েছে, ভারত তা মোকাবিলা করতে কেবল পশ্চিমাদের প্রতিক্রিয়ার ওপরই নির্ভর করবে বলে মনে হয় না। আঞ্চলিক রাজনীতির ওপর এ প্রভাব সহজে দৃশ্যমান হবে না, কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে এ প্রভাব হবে না।
 
সেনা অভ্যুত্থানে বাংলাদেশের সঙ্গে মিয়ানমারের সম্পর্কে বড় ধরনের পরিবর্তনের সম্ভাবনা নেই। কেননা, বাংলাদেশ–মিয়ানমার সম্পর্কের প্রধান বিষয় হচ্ছে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রত্যাবাসন। সু চি সরকার এ বিষয়ে যে নীতি অনুসরণ করেছে, সেটি সেনাবাহিনীরই নীতি। কিন্তু সম্পর্কের ক্ষেত্রে স্থিতাবস্থা বদলে যেতে পারে, যদি ব্যাপক আন্তর্জাতিক সমালোচনা এবং সম্ভাব্য নিষেধাজ্ঞার মুখে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী কিছু শরণার্থীকে প্রত্যাবাসনের মাধ্যমে বাংলাদেশকে তাদের পক্ষে টানার চেষ্টা করে। বিপরীতক্রমে সেনাবাহিনী নিপীড়ন-নির্যাতন বৃদ্ধি করলে নতুন করে শরণার্থীরা সীমান্ত অতিক্রম করতে পারে। বাংলাদেশ সরকারের উচিত হবে দুই সম্ভাব্য দৃশ্যপট বিবেচনায় কৌশল নির্ধারণ করা।
 
আলী রীয়াজ যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর, আটলান্টিক কাউন্সিলের অনাবাসিক সিনিয়র ফেলো এবং আমেরিকান ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজের প্রেসিডেন্ট।
Posted in News Blogs on February 07 2021 at 03:20 AM

Comments (0)

No login
color_lens
gif