করোনাকাল : ই-কমার্সে নারী উদ্যোক্তাদের সাফল্যের স্বর্ণ সময়

 
 
ডিজিটাল বাংলাদেশ এবং ই-কমার্স সম্পর্কে বলতে গেলে বলতে হয় একুশ শতকে বাংলাদেশকে ডিজিটাল বাংলাদেশ হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্য নিয়ে ২০২১ সালে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালনের বছরে বাংলাদেশকে একটি মধ্যম আয়ের দেশ এবং তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর 'ডিজিটাল বাংলাদেশ' বিনির্মাণ করাই ছিল বর্তমান সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দ্বিতীয়বারের মতো শপথ নেয়া নির্বাচনী ইশতেহারের প্রধান বিষয়। ২০১১ সালে যাত্রা শুরু করে বাংলাদেশের জনপ্রিয় ই-কমার্স সাইট সেলবাজার ডট কম। যার বর্তমান নাম এখনি ডট কম এবং আজকের ডিল ডট কম। ২০১২ সালে যাত্রা শুরু করে বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় ই-কমার্স সাইট রকমারি ডট ২০১৩ সালে বাংলাদেশে ই-কমার্স জগতে তৈরি করে নতুন দিগন্ত। বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যাসিস ও অন্য প্রতিষ্ঠান ই-কমার্সকে জনপ্রিয় করতে শুরু করে নানান কর্মসূচি,মেলা সেমিনার ইত্যাদি। বাংলাদেশের ই-কমার্সের ইতিহাসে একটি মাইলফলক বর্ষ হিসেবে ২০১৪ সালকে ধরা যেতে পারে। এ বছর অনলাইন শপ তাদের সম্মিলিত প্রয়াসে যাত্রা শুরু করে ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশান অব বাংলাদেশ বা ই ক্যাব। যাত্রার শুরুতে বহুমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করে সংস্থাটি। ফলে দিশেহারা উদ্যোক্তারা ভরসা ও আত্মশবিশ্বাস ফিরে পাই। স্বপ্ন দেখতে শুরু করে একটি নতুন দিনের, বিশেষ করে উদ্যোক্তাদের ব্যবসায়িক সমস্যাগুলোর সমাধান করতে এগিয়ে আসে ই ক্যাব।
 
আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অনেক হিসাব-নিকাশ পাল্টে দিয়েছে দীর্ঘ করোনাভাইরাস পরিস্থিতি। একটা সময় ফেসবুক ছিল শুধুই একটা যোগাযোগ মাধ্যম, যেখানে অনেক পুরানো বন্ধু খুঁজে পাওয়া যেত। দেশে ও দেশের বাইরের আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা হতো। কিছুটা বিনোদন, কিছুটা অলস সময় কাটানোর ক্ষেত্র ছিল ফেসবুক। কিন্তু বর্তমানে উদ্যোক্তাদের জন্য এই ফেসবুক একটি জনপ্রিয় মাধ্যম হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফেসবুকের মাধ্যমে উদ্যোক্তারা পণ্য কেনাবেচা করতে পারছেন। আর এটা বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে মহামারীর এই সময়টিতে। যেখানে আমরা হাজার হাজার নারী উদ্যোক্তাকে কাজ করতে দেখছি। নারীরা তাদের পণ্য কেনাবেচা থেকে শুরু করে নেটওয়ার্কিং, নানা বিষয়ে কর্মশালা ও ট্রেনিংয়ে অংশগ্রহণ পর্যন্ত করতে পারছেন। শিল্প সংস্কৃতিও বাদ যায়নি। ফলে এই প্ল্যাটফরমে থেকে অনেকেই তাদের হতাশা কাটিয়ে সুন্দর ভবিষ্যতের পরিকল্পনা করতে পেরেছেন এবং ফেসবুককে মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করে স্বল্প পুঁজিতেই উদ্যোক্তা হয়ে উঠছেন নারীরা। গহনা, পোশাক, হাতে তৈরি জিনিস,আচার, পিঠা পুলি,বাচ্চাদের খেলনাসহ নানা রকম পণ্য বিক্রি করছেন উদ্যোক্তাদের কেউ কেউ।
 
বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে নারীদের ঘরে বসে কাজ করার সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে ই-কমার্স। গত কয়েক বছরে অনলাইনভিত্তিক ই-কমার্স ব্যবসার বিশাল একটি বাজার গড়ে উঠেছে। আর দেশের অনলাইন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের একটি বড় অংশেরই নেতৃত্ব দিচ্ছেন নারী উদ্যোক্তারা।
 
এখানে অল্প অর্ধ শিক্ষিতের পাশাপাশি উচ্চ শিক্ষিত নারীরাও আছেন, যাদের হয়তো সংসারের চাপে কিংবা নানা সমস্যায় চাকরি করা সম্ভব হয়নি। অনেকে আবার নিজে কিছু করবেন বলে ভাবছিলেন। ফলে ঘর সামলানোর পাশাপাশি স্বাধীন এ ব্যবসায় আগ্রহ বাড়ছে নারীদের।
 
ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ই-ক্যাব) তথ্য বলছে, এখন দেশে প্রায় ২০ হাজার ফেসবুক পেজে কেনাকাটা চলছে। এর মধ্যে ১২ হাজার পেজ চালাচ্ছেন নারীরা। এই এক বছরে ই-কমার্স খাতে লেনদেন হয়েছে ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা।
 
এদিকে বৈশ্বিক কোভিড-১৯ মহামারীর আর্থিক ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে ৫ এপ্রিল ২০২০ সোনার বাংলার স্বপ্নদ্রষ্টা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৭২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেন। এর মধ্যে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতের জন্যও রয়েছে ২০ হাজার কোটি টাকা। করোনাভাইরাসের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত নারী উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীদের ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ করে আর্থিক প্রণোদনার পাশাপাশি টেকনিক্যাল সহায়তা প্রদানেরও নির্দেশ দিয়েছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
 
কটেজ, মাইক্রো, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের (সিএমএসএমই) জন্য প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত ২০ হাজার কোটি টাকা প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় ঋণ বিতরণের জন্য ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রয়োজনীয় তহবিল সরবরাহের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক আগামী ৩ বছরের জন্য ১০ হাজার কোটি টাকার আবর্তনশীল (ৎবাড়ষারহম) পুনঃঅর্থায়ন তহবিল গঠন করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক এ তহবিল থেকে প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় বিতরণকৃত ঋণের সর্বোচ্চ ৫০% ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ৪% সুদে পুনঃঅর্থায়ন করবে। এ তহবিল গঠনের ফলে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর তহবিল সরবরাহ নিশ্চিত হবে এবং উদ্যোক্তারা সহজেই ঋণ পাবেন বলে আশা করা যায়। ২৭ এপ্রিল ২০২০ এ সংক্রান্ত এক সার্কুলার জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক।
 
নোভেল করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে সিএমএসএমই খাতের জন্য বিশেষ আর্থিক সহায়তা প্যাকেজ-২ অনুসারে সুবিধাপ্রাপ্তির জন্য এসএমই উদ্যোক্তাদের ব্যবসায়িক লেনদেন পরিচালনাকারী ব্যাংকের শাখায় অথবা নিকটস্থ যে কোনো ব্যাংকের শাখায় যোগাযোগ করার অনুরোধ জানিয়েছে সরকার।
 
মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ফজিলাতুন নেসা ইন্দিরা ৩১ মে ২০২০ সচিবালয়ে তার অফিস কক্ষে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাবৃন্দ, দফতর-সংস্থার প্রধান ও প্রকল্প পরিচালকদের সঙ্গে আয়োজিত এক সভায় নারী উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীদের ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ করে আর্থিক এবং টেকনিক্যাল সহায়তা প্রদানের নির্দেশনা দেন।
 
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা করোনাকালীনও নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। করোনার কারণে পহেলা বৈশাখ ও ঈদে নারী উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীরা পোশাক এবং তাদের উৎপাদিত বিভিন্ন পণ্যসামগ্রী বিক্রি করতে পারেননি। তাই উপজেলা ও জেলা পর্যায়ের অফিস থেকে তথ্য সংগ্রহ করে ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা তৈরি করতে হবে। অনলাইনে এসব পণ্যসামগ্রী বিক্রির জন্যে উদ্যেক্তাদের প্রযুক্তিগত সহায়তা ও প্রশিক্ষণ দিতে হবে।
 
দেশের জনসংখ্যার অর্ধেক নারীকে বাদ দিয়ে প্রকৃত উন্নয়ন সম্ভব নয়। তাই নারীবান্ধব ব্যবসার পরিবেশ তৈরিতে কাজ করছে সরকার। দেশের নারী উদ্যোক্তাদের করোনাভাইরাস-পরবর্তী অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার কার্যক্রমে অংশ নিয়ে আবারো ঘুরে দাঁড়াতে ই-কমার্স নিশ্চয়ই সহায়ক হিসেবে কাজ করবে। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের সিনিয়র সচিব এনএম জিয়াউল আলম জানান, দেশের নারী উদ্যোক্তাদের নেটওয়ার্কিং প্ল্যাটফরম ওমেন অ্যান্ড ই-কমার্স (উই) ফোরামের নারী সদস্যদের বিশ্বখ্যাত 'এন্ট্রাপ্রেনারশিপ মাস্টারক্লাস ১.০' সিরিজের আওতায় প্রশিক্ষণ দিয়ে উদ্যোক্তা তৈরিতে সহায়তা করবে সরকার। এ লক্ষ্যে ইতোমধ্যে একটি উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।
 
এসএমই ফাউন্ডেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সফিকুল ইসলাম বলেন, ১০ বছর আগেও শতকরা ৪৩ ভাগ অভিভাবক তাদের মেয়ে সন্তানদের উদ্যোক্তা হওয়ার পক্ষে মত দিতেন না। কিন্তু সেই পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়েছে, নারীরা এখন উদ্যোক্তা হতে আগ্রহী। একসময় অনলাইন ব্যাংকিং, মাস্টার কার্ড, ডেবিট ক্রেডিট কার্ড, ভিসা কার্ড, মোবাইল ব্যাংকিং এসব সুযোগ সুবিধা ছিল স্বপ্নের মতো। কিন্তু এই ডিজিটাল যুগের কল্যাণে আজ সবার হাতে হাতে বিভিন্ন ক্রেডিট কিংবা ডেবিট কার্ড, যা অনলাইন ব্যবসাকে করেছে আরো সহজ আর নিরাপদ।
 
ঘরে বসে থেকে নিজেকে যেন হারিয়ে ফেলতে না হয়, ই-কমার্স সে নিশ্চয়তা দেয়। পাশাপাশি স্বল্প বিনিয়োগ, স্বল্প সময়, পৃথিবীজুড়ে ব্যবসা যেখানে নেই কোনো পরোক্ষ খরচ, আছে স্বল্প মূল্যে কার্যকর মার্কেটিং,সহজ পরিচালনা, সহজ অনলাইন পেমেন্ট ব্যবস্থা এবং যেখানো সুযোগ রয়েছে ২৪ ঘণ্টাই ব্যবসার সুযোগ।
 
এসব বহুবিধ কারণে আজকাল নারীরা অনলাইন ব্যবসায় বেশি আগ্রহী হয়ে উঠছেন। আর এ সময়টায় কোভিড, লকডাউন, যানজট, ব্যস্ততা, সময়ের অভাব শপিং মলে না যাওয়া ইত্যাদি বহু কারণ থাকার পরও ই-কমার্স এর গুণে ক্রেতারা অনলাইনে অর্ডার করে ঘরে বসেই পেয়ে যাচ্ছেন তাদের পছন্দের পন্যটি। সব মিলিয়ে বলা যেতে পারে, বর্তমানের এই ভয়াবহ দুঃসময়কে কাজে লাগিয়ে ব্যবসায় বাংলাদেশের নারীরা সাফল্যের স্বর্ণ যুগ হিসেবে গড়ে তুলতে পেরেছেন এবং তা সম্ভব হয়েছে ই-কমার্সের গুণে। ই-কমার্স সম্ভাবনার উন্মুক্ত আকাশ হিসেবে কাজ করছে বাংলাদেশের উদ্যোক্তাদের সাফল্য অর্জনের পেছনে। তবে সবকিছুর মূলে রয়েছে বর্তমান সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার পূর্ব পরিকল্পনা ও স্বপ্ন। বর্তমান পরিস্থিতি ই-কমার্সের জন্য পালে হাওয়া লাগিয়েছে। আর ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের উন্নয়নে সর্বদাই কাজ করে যাওয়া আমাদের নারীবান্ধব সরকার, সেই পালের নৌকার হাল ধরে আছেন- এ সত্য অস্বীকার করার কোনো উপায়ই নেই।
 
 
Posted in News Blogs on February 07 2021 at 02:51 AM

Comments (0)

No login
color_lens
gif