বৈশ্বিক জ্ঞান সূচকে উন্নতি করতে আমাদের করণীয়

 
 
 
 
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মধ্যে যখনই কোনো তুলনামূলক সমীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়—হোক সেটা অর্থনীতি, দুর্নীতি অথবা বিশ্ববিদ্যালয়ের মান সম্পর্কিত—বাংলাদেশের অবস্থান বরাবরই থাকে একেবারে নিচের দিকে! কয়েক দশক ধরেই চলে আসছে এ অবস্থা। মাসখানেক আগে জাতিসংঘের উন্নয়ন কর্মসূচি ও মোহাম্মদ বিন রশিদ আল মাকতুম জ্ঞান ফাউন্ডেশনের যৌথভাবে করা ‘২০২০ গ্লোবাল নলেজ ইনডেক্স’ (একও) নামের একটি সমীক্ষায় দেখা গেল বিশ্বের ১৩৩টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১১২তম। এ জরিপ অনুযায়ী দক্ষিণ এশিয়ার ছয়টি দেশের মধ্যেও বাংলাদেশের অবস্থান সবার নিচে: #৬!
 
বাংলাদেশীদের জন্য এটা স্বভাবতই দুঃখজনক। কিছু বিশেষজ্ঞ, তাদের মধ্যে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, শিক্ষার ক্ষেত্রে বিনিয়োগের অভাব এবং জ্ঞানের প্রজ্বলনের চেয়ে কাঁচা তথ্যের সর্বব্যাপী উপস্থিতিকে এই দুর্যোগের কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন; গণসাক্ষরতা অভিযানের পরিচালক ও তত্ত্বাবধায়ক অধ্যাপক রাশেদা কে চৌধুরী প্রধানত প্রাথমিক শিক্ষায় একাধিক ট্র্যাক এবং প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষকের অভাব থেকে সৃষ্ট এ সমস্যাগুলোর কথা উল্লেখ করেছেন।
 
শুধু বৈশ্বিক জ্ঞান সূচকেই নয়, বছরের পর বছর বিশ্বের বেশির ভাগ দেশের তুলনায় প্রতিটি সূচকেই আমরা থাকি তলার দিকে। আমরা মানব উন্নয়ন সূচকে ১৮৯টি দেশের মধ্যে ১৩৫তম, গ্লোবাল ডেভেলপমেন্ট ইনডেক্সে ১৯৩-এর মধ্যে ১১৯তম, মানব স্বাধীনতা সূচকের ১২২টির মধ্যে ১৩৯তম, প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্সের ১৮০-এর মধ্যে ১৫১তম এবং গ্লোবাল ইনোভেশন সূচকে ১৩১-এর মধ্যে ১১৬তম দেশ! এগুলো শুধু ২০২০ সালের অবস্থান। ২০১৯, ২০১৮, ২০১৭—এ বছরগুলোয়ও আমরা ছিলাম প্রায় একই রকমের অবস্থানে। অর্থাৎ বছর থেকে বছরে আমাদের কোনো উন্নতি হচ্ছে না! গত দশকে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও অবকাঠামোর উন্নতি হয়েছে আশাতীত রকমের এবং আশা  করা যাচ্ছে বাংলাদেশ কয়েক বছরের মধ্যেই একটি মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হবে। এই শুভ সময়ের সন্ধিক্ষণে যদি আমরা জ্ঞান আর প্রযুক্তির ব্যবহারে এতটা পিছিয়ে থাকি তাহলে অর্থনৈতিক উন্নতিও দীর্ঘস্থায়ী হবে না বলে আশঙ্কা করাও হচ্ছে। 
 
যেকোনো সমস্যা সমাধান করার জন্য (১) সমস্যাটা কী, কেন—খুঁজে বের করা; (২) সম্ভাব্য সমাধানগুলো ঠিক করা; (৩) সমাধানগুলো কার্যকর করা; (৪) সমাধানগুলো কাজ করছে কিনা সেটা মূল্যায়ন করা; (৫) প্রক্রিয়াটি সংশোধন করা এবং কাজ চালিয়ে যাওয়া দরকার।
 
 বৈশ্বিক জ্ঞান সূচকের উদ্দেশ্য যেকোনো একটি দেশের জনগণ তাদের জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে লব্ধ জ্ঞান কীভাবে নিজের এবং তার পারিপার্শ্বিক অবস্থা উন্নতির জন্য ব্যবহার করে সেটা দেখা। এ ব্যাপারটা বোঝার জন্য একও সেই দেশের স্কুল, বিশ্ববিদ্যালয়, প্রযুক্তি—এগুলো কতটা কার্যকরী, সেটা পর্যবেক্ষণ করে এবং সেগুলোকে মূল্যায়ন করে। তার ভিত্তিতেই তৈরি এই সূচক।  আমাদের ধারণা, একটি জাতির জ্ঞানের উন্নতি সেই দেশের দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক নীতিমালা, রাজনীতিবিদদের দূরদর্শিতামূলক কাজ এবং জ্ঞান-বিজ্ঞান সম্পর্কে আমাদের সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের প্রয়োগের ওপর নির্ভর করে।
 
একওর জরিপকৃত দেশগুলোয় জাতীয় শিক্ষা খাতে গড়ে জিডিপি ব্যয়ের পরিমাণ ৪ দশমিক ৫ শতাংশ; বাংলাদেশ ব্যয় করে মাত্র ১ দশমিক ৩ শতাংশ; জরিপকৃত ১৯৭টি দেশের মধ্যে ১৮২টি দেশ বাংলাদেশের চেয়ে বেশি ব্যয় করে। এর মধ্যে মাত্র ১৫টি দেশ বিনিয়োগ করে তাদের জিডিপির ২ শতাংশের কম। এই ১৫টি দেশের মধ্যেও বাংলাদেশ ব্যয়ের ক্ষেত্রে বেশির ভাগ দেশের পেছনে, এমনকি দক্ষিণ সুদান, নাইজেরিয়া, সোমালিয়া—এই দেশগুলোও শিক্ষা খাতে বাংলাদেশের চেয়ে বেশি ব্যয় করে; দক্ষিণ এশিয়ার ছয়টি দেশের মধ্যেও সবচেয়ে কম খরচ করে বাংলাদেশ। জনসংখ্যার তুলনায় প্রাথমিক বিদ্যালয়প্রতি শিশু সংখ্যা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনায় শিক্ষার্থীর সংখ্যা—এই ব্যাপারগুলোয়ও দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের স্থান পঞ্চম! এগুলোর পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ যে জ্ঞান অর্জন ও জ্ঞানের ব্যবহারে পিছিয়ে থাকবে, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এ সমস্যা সমাধান করতে হলে আমাদের দীর্ঘমেয়াদি ব্যবস্থা নিতে হবে। কয়েক দশক ধরে শিক্ষা খাতে জাতীয় বাজেটের যে পরিমাণ টাকা বরাদ্দ করা হচ্ছে, তা দিয়ে অনেক দিনের পুরনো শিক্ষা ব্যবস্থাকে উজ্জীবিত করে একবিংশ শতাব্দীর মানসম্পন্ন করা দূরে থাকুক, এ দিয়ে ক্রমবর্ধমান শিক্ষার্থীদের প্রাথমিক প্রয়োজন মেটানোই দুঃসাধ্যের ব্যাপার। অর্থাৎ আমরা যদি বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে চাই, আমাদের নতুন প্রজন্মকে বিশ্বের বাজারে সক্ষম মানবসম্পদ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চাই তাহলে শিক্ষাকে অগ্রাধিকার দিয়ে এ খাতে যথেষ্ট পরিমাণ বিনিয়োগ করতে হবে। অন্যথায় আমাদের মানসম্মত শিক্ষা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে না।
 
বাংলাদেশে শিক্ষা উন্নতি ও জ্ঞানের চর্চার জন্য আমাদের রাজনীতিবিদরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন। যেহেতু দেশের কোন খাতে কখন, কতটুকু বিনিয়যোগ করা হবে, তার সিদ্ধান্ত ক্ষমতায় অধিষ্ঠিতরাই নিয়ে থাকেন, তারা যদি জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাকে উন্নত করার দাবি করেন, জনাধারণের কাছে এর গুরুত্ব তুলে ধরেন, শিক্ষা খাতে টাকা বরাদ্দ করেন, শিক্ষকদের জন্য বর্তমান সময়ের উপযোগী প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন, ছাত্রদের পড়াশোনার ব্যাপারে উৎসাহিত করেন তাহলেই আমাদের শিক্ষা ও জ্ঞানের চর্চার ব্যাপারে অগ্রগতি করা সম্ভব।
 
পরিশেষে, আমার মতে, আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার অব্যাহত অবনতি ও ব্যর্থতার জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী সম্ভবত আমাদেরই নিজস্ব সংস্কৃতি! পড়াশোনা করা, জ্ঞানার্জন করা এবং সেই জ্ঞানের ভিত্তিতে সমাজ ও মানুষের সেবা করার চেষ্টা করা যে আমাদের সমাজে খুব বুদ্ধিমানের কাজ নয়, সেটা আমরা সবাই জীবনের অনেক ক্ষেত্রেই উপলব্ধি করেছি এবং করে যাচ্ছি। পড়াশোনা করাটাকে আমাদের সমাজে খুব সম্মানের চোখে দেখা হয় না; তার কারণ এটা করে সাধারণ হিসেবে ভালোভাবে বাঁচা যায় না। যে ছেলেটি কখনো পড়াশোনা না করে গুণ্ডামি-বদমায়েশি করেছে, অসৎ পথে চলেছে, অনৈতিক কাজকর্মে উপায়-উপার্জন করেছে, সেই ছেলেটিই জীবনে টাকা-পয়সা, বাড়ি-গাড়ির মালিক হয়েছে; বড় ব্যবসায়ী, স্থানীয় দলের নেতা হয়েছে; বড় চাকরি পেয়েছে এবং নিজেকে সমাজের উঁচু স্তরে প্রতিষ্ঠিত করেছে। এ রকম উদাহরণের কমতি নেই আমাদের দেশে। এদের এই সামাজিক স্বীকৃতি আমাদের নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের নিরুৎসাহিত করে। আমরা আইন-শৃঙ্খলা ভঙ্গকারীদের, চোর-ডাকাতদের, বর্বর-খুনিদের প্রশ্রয় দিই, তাদের উচ্চমর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করি! আমরা শিক্ষাকে মূল্য দিই না, শিক্ষাকে জীবনে প্রতিষ্ঠিত করি না। আমরা শিখতে চাই না, যারা শিখেছে তাদের মূল্যায়ন করি না। আমরা জাতিগতভাবে শেখার এবং জ্ঞানার্জনের পরিশ্রম থেকে যতটা সম্ভব দূরে থাকার চেষ্টা করি।
 
সমাজের এই অসুস্থ ব্যবস্থাগুলোকে ভেঙে নতুন, সুস্থ সমাজ গড়ার প্রতিশ্রুতি নিতে হবে আমাদের। জ্ঞানের প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি, ন্যায়-অন্যায়ের প্রতি আমাদের মূল্যবোধ, সমাজ ও মানুষের প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি—এসবের আমূল পরিবর্তন করে সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা করতে হবে। নতুন প্রজন্মের মানুষগুলোর মনে নৈতিক মূল্যবোধের ভিত্তি তৈরি করতে হবে, তাদের জীবনের শুরু থেকে সঠিক শিক্ষার সুযোগ দিতে হবে, সৃজনশীলতা শেখাতে হবে, প্রশ্ন করতে দিতে হবে, সেই প্রশ্নের জবাব তাদের নিজেদেরই খুঁজে বের করতে উৎসাহ দিতে হবে; তাদের বর্তমান বিশ্বের উপযোগী দক্ষ মানবসম্পদ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। সুস্থ সমাজ গড়ার কাজ সময়সাপেক্ষ। এ ব্যবস্থা চলতে হবে লম্বা সময় ধরে। এর কোনো বিকল্প নেই। 
 
জ্ঞান-বিজ্ঞানে এগোতে হলে, পৃথিবীতে নিজেদের সম্মানের আসনে দেখতে হলে কষ্ট করতে হবে; লেগে থাকতে হবে; নতুন করে নিজেদের গড়তে হবে। একমাত্র তখনই আমরা বৈশ্বিক জ্ঞান সূচকে নিজেদের দেখতে পাব ওপরের দিকে। 
 
 
 
 
Posted in News Blogs on January 23 2021 at 02:57 AM

Comments (0)

No login
color_lens
gif