মিলাদ অনুষ্ঠান উদযাপন প্রসঙ্গে

মিলাদ অনুষ্ঠান উদযাপন প্রসঙ্গে
হক্কানী ওলামায়ে কেরামের মূল্যবান অভিমত।
পর্ব নং {৪৯)
-----------------------------------------------------------------------
অভিমত নং {০১}
----------------------------------------------
ইমাম হাফেজ জালাল উদ্দিন সুয়ূতী রহমতুল্লাহি আলাইহি এর অভিমত-
ইমাম হাফেজ সুয়ূতী তার প্রনীত الحاوي للفتاوى কিতাবের ১৮৯ পৃষ্ঠায়। حسن المقصد في عمل المولد
নামক একটি অধ্যায়ের সংযোজন করেছেন। অধ্যায়ের শুরুতে তিনি বলেন, রবিউল আউয়াল মাসে নবীজির জন্ম দিনের আমল সম্পর্কে প্রশ্ন উত্থাপিত হয় যে, ইসলামী শরীয়তের দৃষ্টিকোণ থেকে এর হুকুম কী ? এটি প্রশংসনীয় না নিন্দনীয়? এবং এর পালনকারীকে সাওয়াব প্রদান করা হবে কি হবে না?
উত্তরঃ আমার মতে এ প্রশ্নের উত্তর হলো- জালালুদ্দীন সুয়ূতী রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন, নিশ্চয়ই মিলাদ শরীফের মৌলিকতা হলো মানুষের একত্রিত হওয়া, কুরআনুল কারীম থেকে কিছু আয়াত তেলাওয়াত করা, নবী করীম সাল্লাল্লাহু সাল্লাম এর আবির্ভাব সম্পর্কিত কিছু ঘটনা অলৌকিক নিদর্শন বর্ণনা করা, এরপর উপস্থিত লোকদের জন্য খাবার পরিবেশন করা, এবং তারা আর কিছু না করে অনুষ্ঠান শেষে ফিরে যাওয়া। এটা বেদাতে হাসানা এর অন্তর্ভুক্ত। যার পালনকারীকে সওয়াব প্রদান করা হবে। কেননা এতে নবী করীম সাল্লাল্লাহু সাল্লাম এর প্রতি মর্যাদা, সম্মান প্রদর্শন ও তাঁর পবিত্র জন্মের কারণে আনন্দ প্রকাশ করা হয়।
অভিমত নং {০২}
----------------------------------------------
শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া এর অভিমত।
তিনি তার কিতাব
دار الحديث اقتضاء الصراط المستقيم
প্রকাশনী কর্তৃক মুদ্রিত এর ২৬৬ পৃষ্ঠায় বলেন, যার মূল ভাষ্য হল-
وكذلك ما يحدثه بعض الناس اما مضاهاة للنصاري في ميلاد عيسى عليه السلام واما محبة للنبي صلى الله عليه وسلم وتعظيما له والله قد يثيبهم على هذه المحبة والاجتهاد
অর্থ অনুরূপভাবে কিছু মানুষ আল্লাহর নবীর জন্ম দিবস উপলক্ষে যা উদ্ভাবন করেছে হয়তো তা ঈসা আঃ এর জন্ম দিবসে নাসারারা যা করে তার সাথে সাদৃশ্য রেখে। অথবা নবী পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর মহব্বাত ও তাজিমের জন্য করে থাকে। আর আল্লাহ তা'আলা তাদেরকে মহব্বতের ওপর সওয়াব দিবেন।
তিনি আরও উল্লেখ করেছেন, এটা এমন একটি আমল, চাহিদা থাকা এবং প্রতিবন্ধকতা না থাকা সত্ত্বেও সলফগন এর আমল করেননি। আর এটি তাদের কথা যারা গোড়ামি পরিহার করেন এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সন্তুষ্টির উদ্দেশ্য কথা বলে ।
আর আমরা জন্ম দিবস এর আমল সে দৃষ্টিকোণ থেকে পালন করে থাকি, যার ব্যাখ্যা শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া দিয়েছেন,
محبة للنبي صلى الله عليه وسلم وتعظيما له
অর্থ নবী কারীম সাল্লাল্লাহু সাল্লামকে ভালোবাসা ও তার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করার উদ্দেশ্যে।
আর আল্লাহ তায়ালা এ প্রচেষ্টার অবশ্যই পুরস্কার প্রদান করেন।
কবি বলেন,
আল্লাহ বক্তার বক্তব্য কতই না চমৎকার,
دعا ماادعته النصارى في نبيهم
واحكم بما شءت مدحا فيه واحتكم
وانسب الي ذاته ما شءت من شرف
وانسب إلى قدره ما شءت من عظم
فان فضل رسول الله ليس له
حد فيعرب عنه ناطق بفم .
খিষ্টান জাতি তাদের নবীর ব্যাপারে যা কিছু দাবি করেছে তা ছেড়ে দাও এবং তার প্রশংসায় মনের ইচ্ছা অনুযায়ী সিদ্ধান্ত দাও এবং সিদ্ধান্ত চাও।
রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম এর সাথে তুমি যত ইচ্ছা মর্যাদা সম্পৃক্ত কর এবং তার মর্যাদার প্রতি যত ইচ্ছা মহত্য সংযত করো। কেননা রাসুলের সালামের মর্যাদার কোনো সীমা নেই যে, কোন বক্তা মুখের ভাষায় তা প্রকাশ করবে।
অভিমত নং {০৩}
----------------------------------------------
শায়খুল ইসলাম
ইবনে হাজার আসকালানী (রহঃ) এর অভিমত।
হাফেজ সূয়ুতী রাহমাতুল্লাহ তারপর পুরবক্ত কিতাবের মধ্যে বলেন, যার মূল ভাষ্য হল-
শাইখুল ইসলাম আবুল ফজল ইবনে হাজার আসকালানী রহঃ মাতুল্লাহি ,রাসূলুল্লাহ সাল্লাম এর জন্ম দিনের আমল সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হয়েছিল। অতঃপর তিনি যে উত্তর দিয়েছিলেন তার মূল কথা হলো,
জন্ম দিবস এর আমলের মূলভিত্তি নতুন সৃষ্টি যা বেদাত বা পূরবর্তী তিন যুগ থেকে সাব্যস্ত হয়নি। কিন্তু এতদ সত্যেও এ নতুন সৃষ্টি (বেদাত) বিষয়টির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে অনেক সুন্দর ও খারাপ দিক। অতএব, যে বা যারা ভালো দিকগুলো যাচাই-বাছাই করে আমল করে, এবং খারাপ দিক গুলো থেকে দূরে থাকে , তখন তা بدعة حسنة বেদাতে হাসানা বা সুন্দর নতুন সৃষ্টি হিসেবে পরিগণিত হবে। নচেৎ নয়।
আমার নিকট মিলাদুন্নবীর উৎস একটি মজবুত ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত বলে প্রমাণিত হয়েছে। আর তাহলো যা বুখারী ও মুসলিম শরীফে বর্ণিত হয়েছে, যে নবী করীম সাল্লাহু সাল্লাম যখন মদীনায় আগমন করলেন সেখানকার ইহুদীদেরকে রোজা অবস্থায় পেলেন যে, তারা আশুরার দিনের রোজা রাখে। তিনি তাদেরকে এ সম্পর্কে প্রশ্ন করলেন, অতঃপর তারা উত্তর দিল, এটি এমন একটি দিন, যাতে আল্লাহ তা'আলা ফেরাউনকে পানিতে ডুবিয়ে দিয়েছেন এবং মুসা আঃ কে মুক্তি দিয়েছেন। আর তার কৃতজ্ঞতা বা শুকরিয়া শরুপ আমরা এই দিনে রোজা রাখি।
এ থেকে বোঝা যায়, আল্লাহ তাআলার সীয় নেয়ামত প্রদানের মাধ্যমে ও শত্রুর প্রতিশোধ গ্রহণের হাত থেকে রক্ষা করার মাধ্যমে যে দিবসে তিনি বান্দার ওপর অনুগ্রহ প্রদান করে থাকেন, তার ওপর কৃতজ্ঞতা পোষণ করা যায়।
এক পর্যায়ে তিনি বলেন রহমতে নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম এর আবির্ভাবের নিয়ামত থেকে আর কোন নিয়ামত বড়? আর এটা মিলাদুন্নবীর মৌলিকতার সাথে সম্পৃক্ত।
আর ওই দিনে যে আমলগুলো করা হবে, তা অবশ্যই আল্লাহ তায়ালার শুকরিয়া বা কৃতজ্ঞতা পোষণ করা বোঝায়, এমন কিছু ভেতরে সীমিত থাকা বাঞ্চনীয়। ইতিপূর্বে যা উল্লেখ করা হয়েছে, তথা কোরআন তেলাওয়াত করা, খাবার পরিবেশন করা, দান সদকা করা, ও নবীজির প্রশংসা মূলক এবং অন্তরকে পরকালীন আমল ও কল্যাণমুখী করে কাসিদা পরিবেশন করা।
উদঘাটিত এ দলিল সম্পর্কে বিরোধী পক্ষ বলেন, নিশ্চয়ই এটি বাতিল দলিল ও কিয়াসে ফাসেদ এবং তারা একে অস্বীকার করেন। হায় এসকল অস্বীকারকারীর প্রতি আফসোস ও যার প্রতি অস্বীকার করা হয়।
আর অস্বীকারকারীদের বক্তব্য হলো, নিশ্চয়ই রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু সাল্লাম জন্মদিন পালন করেননি, খোলাফায়ে রাশেদীন,বা অন্য সাহাবায়ে কেরামও করেননি।
আমরা বলব, শুধুমাত্র বর্জন করার সাথে সাথে তা যে নিষিদ্ধ সে মর্মে তার সাথে কোন দলিল না থাকলে নিষিদ্ধ হওয়ার ওপর نص বা দলিল হবে না। বরং বেশি থেকে বেশি কতটুকু বলা যেতে পারে যে, একাজটি বর্জন করা ও শরীয়ত সম্মত। আর বর্জন কৃত কাজটি যে নিষিদ্ধ, তা শুধুমাত্র বর্জন করার দ্বারা বোঝা যায়না, নিষিদ্ধ হওয়ার বিষয়তো বোঝা যাবে তার ওপর ইঙ্গিত বহন কারী দলিলের দারা।
অতএব তাদের এই আপত্তি অগ্রহণযোগ্য। কেননা আমরা জন্মদিবসের আমলের প্রতি পদ্ধতি নিয়ে মতপার্থক্যের কথা বলেছি, ওই দিনের প্রকৃত মৌলিকতা নিয়ে নয়। বিরোধীদের পক্ষ থেকে একটি বিষয়ে দাবি প্রচার করা হয়ে থাকে, নিশ্চয়ই যারা মিলাদ-মাহফিল পালন করে তাদের অধিকাংশই পাপাচারী, যারা সুদের লেনদেন করে ,নামাজের ব্যাপারে উদাসীন থাকে, প্রকাশ্য অপ্রকাশ্য সুন্নত বর্জন করে, সমাজের অনেক অপরাধ ও পাপাচারের সাথে পরিচিত, নানা রকম অশ্লীল ও ধ্বংসাত্মক কাজের সাথে জড়িত। এগুলো স্পষ্ট দুর্নাম ও সুদৃঢ় সাখ্যদাতাদের ওপর মিথ্যা অপবাদ ।
এ ধরনের মিথ্যা অপবাদ রটনাকারীকে অচিরেই পরকালে প্রশ্ন করা হবে। যদি আজ ইহকালে তাকে এ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হয়, অবশ্যই তাকে এ কথার স্বপক্ষে দলীল সাব্যস্ত করতে হবে। নতুবা আল্লাহ তাআলা তাকে শাস্তি দেবেন। আর আমরা প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে শুধু এতটুকু বলব, মহান আল্লাহর পবিত্রতা ঘোষণা করছি । এটি কতইনা বড় মিথ্যা অপবাদ। আরও বলব, যারা নামাজের জামাতে উপস্থিত হয়, রোজা রাখে, হজ করে, ওমরা পালন করে, কোরআন তেলাওয়াত করে, এবং মসজিদে ইতিকাফ করে, তারা সকলেই কি সকল ত্রুটি থেকে মুক্ত?
আমি বলি, তাদের মধ্যে এমন কেউ কি নেই? যে সুদ খায়, মানুষের সম্পদ অন্যায়ভাবে ভক্ষণ করে, এমন কেউ কি নেই ? যে মদ পান করে, অশ্লীল কাজ করে, এমন কেউ কি নেই! যে, ভুল করে এবং তওবা করে, ও গুনাহ থেকে ফিরে আসে, আর প্রত্যেক আদম সন্তানই অপরাধী এবং ভুলত্রুটি মানুষরেই হয়।
হে আল্লাহ আমরা আপনার কাছে অহংকার, আত্ম গম্ভীরতা, আত্ম প্রদর্শন, এবং ঐ ইবলিসের পথ থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করি, যে বলেছিল, আমি তার (আদম) থেকে উত্তম। কেননা আপনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন আগুন থেকে, এবং তাকে সৃষ্টি করেছেন মাটি থেকে।
(সুরা ছোয়াদ - আয়াত নং ৭৬)
ওলামা একরাম বলেছেন, নিশ্চয়ই একজন আলেম যখন বলেন, মানুষ ধ্বংস হোক, এ কথার দ্বারা নিজেকে বড় মনে করে অন্যদেরকে তুচ্ছ জ্ঞান করে, তখন মূলত সেই তাদের মধ্যে সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
Posted in Personal Blogs on December 30 2020 at 05:20 PM

Comments (0)

No login
color_lens
gif