মহামান্য রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর জন্মশতবার্ষিকী 'মুজিববর্ষ-২০২০' উপলক্ষে জাতীয় সংসদের বিশেষ অধিবেশনে উপস্থিত থাকতে পারা আমার জন্য অত্যন্ত আনন্দ ও গৌরবের বিষয়। এটি আমার জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রাপ্তি। এজন্য মহান আল্লাহ তায়ালার দরবারে অশেষ শুকরিয়া জ্ঞাপন করছি। এ উপলক্ষে স্পিকার, সংসদ নেতা ও সংসদ সদস্যসহ প্রিয় দেশবাসী ও দেশের বাইরে বসবাসরত সকল প্রবাসীকে মুজিববর্ষের শুভেচ্ছা জানাচ্ছি।
২. ভাষণের শুরুতেই আমি গভীর শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করছি স্বাধীন বাংলাদেশের মহান স্থপতি, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। সশ্রদ্ধচিত্তে স্মরণ করছি সকল বীর মুক্তিযোদ্ধা ও অমর শহীদকে, যাদের অসীম সাহস ও আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমরা অর্জন করেছি একটি সার্বভৌম দেশ ও স্বাধীন জাতিসত্তা, পবিত্র সংবিধান ও লাল-সবুজ পতাকা। আমি কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করছি জাতীয় চার নেতা- সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এম মনসুর আলী এবং এএইচএম কামারুজ্জামানকে- যারা বঙ্গবন্ধুর পক্ষে মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকারের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।
৩. আমি আরও স্মরণ করছি তাদের, যারা এ দেশের ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে আমাদের গণতান্ত্রিক সংগ্রাম, ভাষা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকারের মর্যাদা সমুন্নত রাখার লড়াইয়ে আত্মত্যাগ করেছেন। শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি বাঙালির গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের সংগ্রামের তিন মহান পুরুষ- শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, গণতন্ত্রের মানসপুত্র হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও মজলুম জননেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীকে- যাদের অবদান আমাদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে গেছে।
৪. আমি পরম শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি সেসব বিদেশি বন্ধুকে যারা আমাদের মুক্তিসংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সহযোগিতা করেছেন। আমি পরম শ্রদ্ধায় আরও স্মরণ করছি ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের নির্মম হত্যাকাে শহীদ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তার সুযোগ্য সহধর্মিণী মহিয়সী নারী বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব ও তিন পুত্র শেখ কামাল, শেখ জামাল, শেখ রাসেলসহ সকল শহীদকে। আমি তাদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি।
৫. কভিড-১৯-এর থাবায় গোটা বিশ্ব আজ বিপর্যস্ত। আমি দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে স্মরণ করছি বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জিকে, যিনি আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে অপরিসীম অবদান রেখেছেন এবং আমৃত্যু বাংলাদেশের শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে ভূমিকা পালন করেছেন। করোনাকালে আমরা আরও হারিয়েছি সাবেক মন্ত্রী ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য মোহাম্মদ নাসিম ও বেগম সাহারা খাতুন, ধর্ম প্রতিমন্ত্রী শেখ মোহাম্মদ আবদুল্লাহ ও বেশ কয়েকজন সংসদ সদস্যসহ অনেক রাজনৈতিক নেতাকে। এছাড়া হারিয়েছি বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, জাতীয় অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী, মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার মেজর জেনারেল (অব.) সি আর দত্ত, লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) আবু ওসমান চৌধুরী, বিশিষ্ট আইনজীবী ও অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম এবং প্রখ্যাত আইনজীবী ও সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল ব্যারিস্টার রফিক-উল হকসহ শিক্ষা, সংস্কৃতি, ক্রীড়া, রাজনৈতিক ও সামাজিক অঙ্গনের অনেক ব্যক্তিত্বকে। আমি তাদের আত্মার মাগফিরাত ও শান্তি কামনা করছি।
৬. জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে 'মুজিববর্ষ' পালনের উদ্যোগ নেওয়ার জন্য আমি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার সরকারকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি। একইসঙ্গে 'মুজিববর্ষ' উপলক্ষে বিশেষ অধিবেশন আয়োজনের জন্য স্পিকার আপনাকে এবং আপনার মাধ্যমে জাতীয় সংসদের সকলকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করছি। চলমান করোনা পরিস্থিতিতে বিশেষ অধিবেশনের আয়োজন নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। আমি আশা করি অধিবেশনের কার্যক্রম বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বঙ্গবন্ধুর জীবন ও কর্ম সম্পর্কে জানাতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। এছাড়া জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত অধিবেশনে জাতির পিতাকে সম্মান জানানোর মাধ্যমে আমরা নিজেরাও সম্মানিত হবো। সীমিত সময় ও পরিসরে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে পূর্ণাঙ্গ আলোচনা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। তার জীবন ও কর্মের বিস্তৃতি এতটাই বিশাল যে ঘণ্টার পর ঘণ্টা, এমনকি দিনের পর দিন আলোচনা করলেও তা অসম্পূর্ণই থেকে যাবে।
৭. বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কিছু বলতে গেলে অনিবার্যভাবে এসে পড়ে ইতিহাস, ইতিহাসের পরম্পরা। ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ তৎকালীন গোপালগঞ্জ মহকুমার নিভৃত পল্লি টুঙ্গিপাড়ার এক সল্ফ্ভ্রান্ত পরিবারে তার জন্ম। ছোটবেলা কেটেছে গ্রামের কাদা-জল, মেঠো পথ আর প্রকৃতির খোলামেলা পরিবেশে। পরোপকার আর অন্যের দুঃখ-কষ্ট লাঘবে সবসময় তিনি নিজেকে জড়িয়ে নিতেন। নিজের সুখ-দুঃখের কথা না ভেবে অন্যকে নিয়ে ভাবতেন। সেই থেকে শুরু। জীবনের প্রতিটি ক্ষণে যেখানেই অন্যায়-অবিচার, শোষণ-নির্যাতন দেখেছেন, সেখানেই প্রতিবাদে নেমে পড়েছেন। কখনও নিজের এবং পরিবারের গি র মধ্যে বাঁধা পড়েননি। ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়েও গেয়েছেন বাংলা, বাঙালি আর বাংলাদেশের জয়গান। ফাঁসির সেলের পাশেই কবর খোঁড়া হচ্ছে জেনেও বাঙালির স্বাধীনতার লক্ষ্যে ছিলেন অবিচল ও অনড়। আজীবন বাংলা ও বাঙালিকে ভালোবেসে গেছেন, স্থান করে নিয়েছেন মানুষের মনের মণিকোঠায়।
৮. ক্ষণজন্মা এই মহাপুরুষ শৈশব থেকেই ছিলেন অত্যন্ত মানবদরদী কিন্তু অধিকার আদায়ে আপসহীন। মাত্র ১৪ বছর বয়সে ব্রিটিশবিরোধী সভা-সমাবেশে অংশ নেন তিনি। গরিব ছাত্রছাত্রীদের লেখাপড়ার খরচ চালাতে গড়ে তোলেন 'মুসলিম সেবা সমিতি'। ১৯৩৮ সালে শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর পরিচয় ঘটে এবং প্রথম পরিচয়েই তিনি নেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হন। ১৯৪৬ সালে কলকাতা ইসলামিয়া কলেজের ছাত্র সংসদ নির্বাচনে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। তারপর ১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান বিভক্তির পর বঙ্গবন্ধু কলকাতা থেকে ঢাকা আসেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে ভর্তি হন। দেশ বিভাগের কিছুদিন পরই তরুণ নেতা শেখ মুজিব বুঝতে পেরেছিলেন, ব্রিটিশ পরাধীনতার কবল থেকে মুক্তি পেলেও বাঙালি নতুন করে পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণের কবলে পড়েছে। বাংলা ভাষার দাবিতে ধর্মঘট পালনকালে ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ শেখ মুজিব সচিবালয় গেট থেকে গ্রেপ্তার হন। অর্থাৎ, পাকিস্তান কায়েম হওয়ার ৮ মাসের মধ্যেই তিনি কারাবরণ করেন।
৯. ১৯৪৯ সালে ১৭ এপ্রিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের আন্দোলনে সহযোগিতা ও সমর্থন দেওয়ার অভিযোগে বঙ্গবন্ধুকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিস্কার করা হয়। মুচলেকা দিয়ে অনেকে ছাত্রত্ব ফিরে পেলেও তিনি সেপথে পা বাড়াননি, তিনি ছিলেন আপসহীন। যেখানেই অন্যায়, অবিচার, শোষণ, নির্যাতন দেখেছেন সেখানেই তিনি প্রতিবাদে নেমে পড়েছেন। জীবনে কখনও নীতি-আদর্শের সঙ্গে আপস করেননি। ভাষার দাবিতে সারাদেশে আন্দোলন ক্রমেই তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে। বঙ্গবন্ধু ১৯৫২ সালের জানুয়ারি মাসে আটকাবস্থায় হাসপাতালে থেকেই অন্য ছাত্রনেতাদের সঙ্গে গোপনে বৈঠক করে একুশে ফেব্রুয়ারি 'রাষ্ট্রভাষা দিবস' পালন এবং সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠন করেন।
১০. আন্দোলন-সংগ্রাম ও কারাভোগের মধ্য দিয়েই শেখ মুজিব বাঙালির অধিকার আদায়ের পথে এগিয়ে চলেন। ১৯৫৩ সালের ৯ জুলাই তিনি ৩৩ বছর বয়সে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৫৩ সালের ১৪ নভেম্বর আওয়ামী মুসলিম লীগের বিশেষ কাউন্সিলে যুক্তফ্রন্ট গঠনের সিদ্ধান্ত নেন এবং ১৯৫৪ সালের ১০ মার্চ যুক্তফ্রন্ট প্রার্থী হিসেবে গোপালগঞ্জ থেকে প্রথমবারের মতো আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৫৪ সালের ১৫ মে যুক্তফ্রন্ট সরকারের সমবায়, ঋণ ও গ্রামীণ পুনর্গঠনবিষয়ক মন্ত্রী নিযুক্ত হন। ১৯৫৪ সালের ৩০ মে কেন্দ্রীয় সরকার পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক সরকার ভেঙে দেয় এবং অন্যান্য রাজনীতিবিদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু গ্রেপ্তার হন।
১১. ১৯৫৫ সালের ৫ জুন বঙ্গবন্ধু আওয়ামী মুসলিম লীগের হয়ে গণপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন এবং পাকিস্তান গণপরিষদে ভাষণদানকালে 'পূর্ব পাকিস্তান' নামের বিরোধিতা করে 'পূর্ববাংলা' করার আহ্বান জানান। একই ভাষণে আঞ্চলিক ও স্বায়ত্তশাসনেরও দাবি জানান। ১৯৫৬ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর জোট সরকারের শিল্প-বাণিজ্য-শ্রম মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব লাভ করেন এবং ১৯৫৭ সালের ৩ এপ্রিল পূর্ব পাকিস্তান চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশন প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৫৭ সালের ৩০ মে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দলীয় রাজনৈতিক কর্মকা পরিচালনার স্বার্থে জোট সরকারের মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন। দলের প্রতি বঙ্গবন্ধুর কতটা আনুগত্য, আন্তরিকতা ও টান ছিল মন্ত্রিপরিষদ থেকে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। ক্ষমতা বা কোনো কিছু চাওয়া-পাওয়া বঙ্গবন্ধুকে তার লক্ষ্য ও আদর্শ থেকে কখনও বিচ্যুত করতে পারেনি- এটাও তার একটি বড় প্রমাণ।
১২. ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খানের সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু দুই বছর কারাভোগ করেন এবং ১৯৬৪ সালে আইয়ুব খানের মৌলিক গণতন্ত্রের বিরোধিতা করে আবারও গ্রেপ্তার হন। কিন্তু কোনো কিছুই শেখ মুজিবকে বাঙালির অধিকার আদায়ের আন্দোলন থেকে দূরে রাখতে পারেনি। ১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু লাহোরে ঐতিহাসিক ৬-দফা উত্থাপনের পর প্রথম তিন মাসেই পাকিস্তানের সামরিক সরকার তাকে আটবার গ্রেপ্তার করে। জেল থেকে বের হয়েই বঙ্গবন্ধু ৬-দফার সমর্থনে জনমত সৃষ্টির লক্ষ্যে দেশের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে ছুটে বেড়ান। জেলজুলুম কিছুই বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। যদিও সামরিক সরকার ৬-দফা নিয়ে জনমত গঠন প্রক্রিয়া ব্যাহত করতে অধিকাংশ সময় বঙ্গবন্ধুকে কারান্তরীণ রাখে। বাঙালির অধিকার আদায়ের সংগ্রামকে প্রতিহত করতে সামরিক সরকার কারান্তরীণ অবস্থায় বঙ্গবন্ধুকে এক নম্বর আসামি করে ৩৫ জন বাঙালির বিরুদ্ধে 'রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্য' শীর্ষক মামলা দায়ের করে, যা 'আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা' নামে পরিচিত। সামরিক সরকারের এমন অগণতান্ত্রিক, নিপীড়ন ও নির্যাতনমূলক কর্মকাে র বিরুদ্ধে পূর্ববাংলার জনগণ রুখে দাঁড়ায়। আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশে। দেশব্যাপী সৃষ্টি হয় গণঅভ্যুত্থান। প্রবল গণআন্দোলনের মুখে পাকিস্তান সামরিক শাসক ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি 'আগরতলা ষড়যন্ত্র' মামলায় আটক শেখ মুজিবসহ অন্য বন্দিদের মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। ২৩ ফেব্রুয়ারি রেসকোর্স ময়দানে লাখো ছাত্র-জনতার সংবর্ধনায় শেখ মুজিবুর রহমানকে 'বঙ্গবন্ধু' উপাধি দেওয়া হয়। এই সমাবেশেই তিনি ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের ১১-দফা দাবির প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানান।
১৩. জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক কর্মকা@ে ব্যক্তি ও পারিবারিক বন্ধন কখনও বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব সবসময়ই বঙ্গবন্ধুকে তার চলার পথে সাহস জুগিয়েছেন, বিপদে ভরসা দিয়েছেন। নিজের ও পরিবারের চেয়ে দেশ ও জনগণের স্বার্থকে বড় করে দেখেছেন। বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিবের অবদান বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনে অনেক বড় বড় সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৬৯ সালের ৫ ডিসেম্বর হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর স্মরণসভায় বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেন 'জনগণের পক্ষ হইতে আমি ঘোষণা করিতেছি আমাদের আবাসভূমির নাম পূর্ব পাকিস্তান নয়, হবে বাংলাদেশ'।
১৪. ইতোমধ্যে বাঙালির মুক্তির সনদ ৬-দফা ও ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ১১-দফার আন্দোলন সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। আন্দোলনে অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে সমগ্র পূর্ববাংলা। পাকিস্তান সামরিক শাসক বাধ্য হয় সাধারণ নির্বাচন দিতে। অবশেষে ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। পূর্ব পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের ১৬৯ আসনের মধ্যে ১৬৭ এবং প্রাদেশিক পরিষদের ৩০০ আসনের মধ্যে ২৮৮ আসনে আওয়ামী লীগ জয়লাভ করে। সৌভাগ্যক্রমে জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে আমি নিজেও পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে সর্বকনিষ্ঠ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হই।
১৫. ৭০-এর বিজয় স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়কে ত্বরান্বিত করে। কিন্তু পাকিস্তানি সামরিক শাসক গোষ্ঠী এর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করে এবং ক্ষমতা হস্তান্তরে নানা টালবাহানার আশ্রয় নিতে থাকে। বঙ্গবন্ধু ৩ জানুয়ারি রেসকোর্স ময়দানে এক বিশাল জনসভায় ১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচনে বিজয়ী জনপ্রতিনিধিদের শপথ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন। পাকিস্তানের সামরিক শাসক ও প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া পূর্ব পাকিস্তানে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ডেকেও পহেলা মার্চ এক ভাষণে বঙ্গবন্ধুকে দোষারোপ করে অনির্দিষ্টকালের জন্য তা স্থগিত করেন। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ক্ষোভে ফেটে পড়ে। আন্দোলনে যোগ হয় নতুন মাত্রা। জনগণ তাদের প্রাণপ্রিয় নেতার দিকনির্দেশনার অপেক্ষায় প্রহর গুনতে থাকে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে ঐতিহাসিক ভাষণ দেন। এই ভাষণে বঙ্গবন্ধু বাঙালির আবেগ ও আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করে বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেন 'এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম' যা ছিল মূলত স্বাধীনতারই ডাক।
১৬. সম্প্রতি মন্ত্রিসভা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণের দিনকে 'ঐতিহাসিক দিবস' হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে, যা একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। একটি ভাষণ কীভাবে গোটা জাতিকে জাগিয়ে তোলে, স্বাধীনতার জন্য মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে উৎসাহিত করে, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ তার অনন্য উদাহরণ। এ ভাষণে বঙ্গবন্ধু শুধু স্বাধীনতার ডাকই দেননি বরং মুক্তিযুদ্ধের রূপরেখা ও ভবিষ্যৎ করণীয় সম্পর্কেও দিকনির্দেশনা দিয়ে গেছেন। এ ভাষণ শুধু বাঙালি জাতির জন্যই নয় বরং সারা বিশ্বের নিপীড়িত নির্যাতিত মুক্তিকামী মানুষের প্রেরণার উৎস। ইউনেস্কো ২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণকে World Documentary Heritage-এর মর্যাদা দিয়ে Memory of the World International Register-এ অন্তর্ভুক্ত করেছে। এজন্য বাঙালি হিসেবে গর্বে আমাদের বুক ভরে ওঠে। এ ভাষণের কারণে বিশ্বখ্যাত নিউজউইক ম্যাগাজিন ১৯৭১ সালের ৫ এপ্রিল সংখ্যায় বঙ্গবন্ধুকে 'Poet of Politics' হিসেবে অভিহিত করে।
১৭. ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালির ওপর গণহত্যা শুরু করে। উদ্ভূত পরিস্থিতি ও পূর্ব পরিকল্পনা অনুসারে বঙ্গবন্ধু ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং ওই দিনই বঙ্গবন্ধুকে হানাদার বাহিনী গ্রেপ্তার করে। তার নির্দেশনা অনুযায়ী কৃষক-শ্রমিক ছাত্র-জনতা যার যা কিছু ছিল তা নিয়েই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ১০ এপ্রিল শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি করে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকার গঠন করা হয় এবং ১৭ এপ্রিল বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে মুজিবনগর সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। তারপরের ইতিহাস সবারই জানা। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে এবং ৩০ লাখ শহীদের রক্ত, দু'লাখ মা-বোনের সল্ফ্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত হয় বাঙালির চূড়ান্ত বিজয়, সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন 'স্বাধীনতা'।
১৮. ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হলেও বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে তা যেন অপূর্ণই থেকে যায়। সাত কোটি বাঙালি তাদের প্রাণপ্রিয় নেতার আসার অপেক্ষায় ক্ষণ গুনতে থাকেন। অবশেষে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি সেই মাহেন্দ্রক্ষণ এলো। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ৮ জানুয়ারি পাকিস্তান কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে লন্ডন পৌঁছান। সেখানে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী স্যার এডওয়ার্ড হিথ তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এছাড়া বঙ্গবন্ধু লন্ডনে একটি সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে বিশ্ববাসীকে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানান। বঙ্গবন্ধু ১০ জানুয়ারি লন্ডন থেকে দিল্লি হয়ে ঢাকায় আসেন। দিল্লিতে ভারতের রাষ্ট্রপতি ভি ভি গিরি ও প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তাকে অভ্যর্থনা জানান। এ সময় তাকে গার্ড অব অনার দেওয়া হয়। পরে বঙ্গবন্ধু বিশাল এক জনসভায় বাংলায় বক্তৃতা করেন। শুরু হলো সদ্য স্বাধীন দেশের এগিয়ে যাওয়ার পথচলা।
১৯. বঙ্গবন্ধু দেশের মাটিতে পা রেখেই যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের অর্থনীতি পুনর্গঠনের কাজে নেমে পড়েন। তিনি কৃষি, শিক্ষা, সংস্কৃতি, স্বাস্থ্য, পর্যটন, প্রতিরক্ষা, যোগাযোগসহ খাতভিত্তিক উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। তিনি কৃষি উৎপাদন বাড়ানোর জন্য ভূমি সংস্কার, সেচযন্ত্র স্থাপন এবং ২৫ বিঘা পর্যন্ত কৃষিজমির খাজনা মওকুফ করেন। ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা, বেতবুনিয়া ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্র স্থাপন, টঙ্গীতে বিশ্ব ইজতেমার জায়গা বরাদ্দ, মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড গঠন এবং পঙ্গু হাসপাতাল স্থাপনে বঙ্গবন্ধুর অবদানকে জাতি আজও পরম শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে। বঙ্গবন্ধু সংবিধানে নারী-পুরুষের সম-অধিকার এবং রাষ্ট্র ও গণজীবনের সর্বস্তরে নারী-পুরুষের সম-অংশগ্রহণের নিশ্চয়তা প্রদান করেন। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশকে প্রতিষ্ঠিত করতে তিনি কূটনৈতিক যোগাযোগ বাড়াতেও উদ্যোগী হন। বঙ্গবন্ধুর ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ও কূটনৈতিক দক্ষতায় বাংলাদেশ ১৯৭৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভ করে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘে বাংলায় ভাষণ প্রদান করে বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতিকে এক অনন্য উচ্চতায় অধিষ্ঠিত করেন। শোষিত ও নিপীড়িত জনগণের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে তথা বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় বঙ্গবন্ধুর অসাধারণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বিশ্বশান্তি পরিষদ তাকে সর্বোচ্চ সম্মান 'জুলিও কুরি' পুরস্কারে ভূষিত করে।
২০. বঙ্গবন্ধু আমৃত্যু আর্থসামাজিক উন্নয়নের পাশাপাশি গণতন্ত্রের উন্নয়নকেও সমান গুরুত্ব দিতেন। তাই ৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু রাজনৈতিক স্বাধীনতার সঙ্গে সঙ্গে অর্থনৈতিক মুক্তির কথা বলেছেন। ১৯৭০ সালে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলেও তৎকালীন শাসকচক্রের চক্রান্তের জন্য সংসদে বসার সুযোগ হয়নি। বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরেই পুনর্গঠন কর্মকাে র সঙ্গে সঙ্গে সংসদকে কার্যকর করার উদ্যোগ নেন। ১৯৭২ সালের ২২ মার্চ রাষ্ট্রপতির ২২ নম্বর আদেশবলে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের জন্য একটি সংবিধান প্রণয়নের লক্ষ্যে গণপরিষদ গঠন করা হয়। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের ১০ এপ্রিল বাংলাদেশের প্রথম 'গণপরিষদ' অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। গণপরিষদের প্রধান দায়িত্ব ছিল দেশের জন্য একটি সংবিধান প্রণয়ন করা।
২১. কনিষ্ঠ ও নবীন সদস্য হিসেবে গণপরিষদের অধিবেশনে অংশগ্রহণ ছিল আমার জন্য খুবই আগ্রহ ও আকর্ষণের। নিতান্ত নবীন সদস্য হিসেবে বয়োজ্যেষ্ঠ ও অভিজ্ঞ সদস্যদের কর্মকা খুবই আগ্রহভরে প্রত্যক্ষ করতাম। পার্লামেন্টারিয়ান বঙ্গবন্ধু তখন ছিলেন আমার আগ্রহের একেবারে কেন্দ্রবিন্দুতে।
২২. বঙ্গবন্ধু গণপরিষদের কার্যক্রমকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতেন। গণপরিষদে কোনো বিরোধী দল ছিল না। বিভিন্ন দল ও স্বতন্ত্র সব মিলিয়ে সদস্যসংখ্যা ১০-এ উন্নীত হয়নি। কিন্তু বিরোধী সদস্যগণ প্রতিবাদমুখর ছিলেন, দীর্ঘক্ষণ বক্তব্য রাখার সুযোগ পেতেন। সংসদ অধিবেশন হতো প্রাণবন্ত। যুক্তিতর্ক ও মতামত উপস্থাপন ছিল খুবই আকর্ষণীয়। সবকিছুর ঊর্ধ্বে ছিল সংসদে স্বয়ং বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতি ও তার ভাষণ। আমার স্পষ্ট মনে আছে ন্যাপ থেকে নির্বাচিত তৎকালীন গণপরিষদ সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের কথা। পার্লামেন্টে বক্তৃতা করার সুযোগ চাইলে সবসময়ই তিনি সুযোগ পেতেন। স্পিকার মাঝে মধ্যে তাকে মাইক দিতে না চাইলেও বঙ্গবন্ধু বলতেন 'ওকে সুযোগ দেন, বিরোধী পক্ষের কথা আগে শুনতে হবে'। সংবিধান প্রণয়নের লক্ষ্যে কমিটি গঠন প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, 'শুধু যে আমাদের দলীয় সদস্য থেকে কমিটি করব তা নয়, দল-মত নির্বিশেষে সকলের সঙ্গে আলোচনা করা হবে, জনগণকে যাতে তাদের ইচ্ছা অনুযায়ী একটা সুষ্ঠু সংবিধান দেওয়া যায়, এই উদ্দেশ্যে সকলের মতামত চাইব, এই সংবিধানে মানবিক অধিকার থাকবে, যে অধিকার মানুষ চিরজীবন ভোগ করতে পারবে'।
২৩. বঙ্গবন্ধু সংসদ কার্যক্রমের পাশাপাশি দলীয় শৃঙ্খলার ব্যাপারেও ছিলেন খুবই সচেতন। এ প্রসঙ্গে প্রথম অধিবেশনের প্রথম কার্যদিবসেই তিনি বলেছিলেন, 'আমি সংসদ-সদস্যদের আর একটা কথা মনে করিয়ে দিতে চাই যে, কোনো প্রস্তাব আনার আগে পার্টিতে তা আলোচনা করে তারপর উপস্থাপন করবেন। তা না হলে এর দ্বারা পার্টির শৃঙ্খলা নষ্ট হবে'।
২৪. বঙ্গবন্ধু সংসদে হাস্যরস করতেও পিছপা হতেন না। একবার সংসদে বক্তব্য দানকালে হাসতে হাসতে বলেছিলেন, 'স্পিকার, আপনার মাধ্যমে অনুরোধ জানাচ্ছি যে, ভবিষ্যতে আমার এই মাইকটি একটু উঁচু করে দেবেন, আমি মানুষ একটু বেশি লম্বা'। হাউস পরিচালনার ক্ষেত্রেও বঙ্গবন্ধু ছিলেন খুবই আন্তরিক। কার্যপ্রণালি বিধি মেনে নিজেও আলোচনা করতেন এবং অন্য সদস্যরাও যাতে তা মেনে চলে সে ব্যাপারেও শক্ত হাতে হাউস চালানোর ব্যাপারে স্পিকারকে অনুরোধ জানাতেন।
২৫. বঙ্গবন্ধু সংসদের সকল কার্যক্রমে বিরোধী সদস্যদের মতামতকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিতেন। Rules of Procedure ওপর আলোচনা করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, 'আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারি পার্টিই একেবারে সবকিছু চূড়ান্ত করে নাই- দুই-একজন যারা নির্দলীয় বা বিরোধী পার্টি যাই বলুন আমার কোনো আপত্তি নাই, যদি আপনাদের ভালো কোনো সংশোধনী থাকে, তা নিশ্চয়ই দেশের মঙ্গলের জন্য মনকে আমরা বড় করে তা গ্রহণ করব'।
২৬. সদস্যদের অভাব-অভিযোগ, সুখ-দুঃখ সবকিছুর খবর রাখতেন বঙ্গবন্ধু এবং প্রয়োজনে তাদের জন্য সম্ভাব্য সবকিছুই করতেন। ১৯৭২ সালের ১০ এপ্রিল গণপরিষদের প্রথম অধিবেশন বসে এবং একই বছরের ৪ নভেম্বর জাতীয় সংসদে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান পাস হয়। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭২ থেকে তা কার্যকর হয়। ১৫ ডিসেম্বর গণপরিষদ বিলুপ্ত হয়। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে এত অল্প সময়ের মধ্যে জাতির জন্য একটি সংবিধান প্রণয়ন ছিল নিঃসন্দেহে একটি বিরাট সাফল্য এবং বিশ্বের গণতন্ত্রকামী সকল দেশের জন্য ছিল অনুকরণীয়।
২৭. সংসদে আরও একটা বিষয় ছিল লক্ষণীয়, পার্লামেন্টে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে কেউ কথা বললে স্পিকার বিব্রত হতেন, কিন্তু বঙ্গবন্ধু হতেন না। উদার না হলে, গণতান্ত্রিক মনোভাবাপন্ন না হলে এটা ভাবাই যেত না। ১৯৭৩ সালে পার্লামেন্টে আতাউর রহমান খান, এমএন লারমাসহ বিরোধী দলের কয়েকজন এমপি ছিলেন। তখনও দেখেছি তারা কথা বলতে চাইলেই সুযোগ পেতেন। প্রায় সময় বঙ্গবন্ধুই স্পিকারকে বলে সে সুযোগ করে দিতেন। বিরোধী দলের প্রতি বঙ্গবন্ধুর আলাদা একটা মনোযোগ ছিল বলেই এটা সম্ভব হয়েছিল।
২৮. বঙ্গবন্ধু সবসময় দেশ ও জনগণের উন্নয়নের পাশাপাশি গণতন্ত্রের উন্নয়ন ও বিকাশের কথা ভাবতেন, গুরুত্বের সঙ্গে বিশ্বাস করতেন সংসদীয় গণতন্ত্রে। যদিও দেশের বিশেষ পরিস্থিতিতে, বঙ্গবন্ধু জাতীয় ঐক্য নিশ্চিতকরণ, দেশের উন্নয়ন এবং দ্রুত অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনের জন্য 'বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ' গঠন করেন। বঙ্গবন্ধু পার্লামেন্টে না থাকা প্রসঙ্গে বলেছিলেন যে, 'আপনারা amendment করে আমাকে প্রেসিডেন্ট করেছেন, এই সিটে আমি আর বসব না- এটা কম দুঃখ না। আপনাদের সঙ্গে এই হাউসের মধ্যে থাকব না- এটা কম দুঃখ নয় আমার'।
২৯. বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ছিল দারিদ্র্য ও ক্ষুধামুক্ত, দুর্নীতি ও শোষণহীন সমৃদ্ধ এক বাংলাদেশ। জাতির পিতার দর্শন ছিল 'বাংলার মানুষের মুক্তি'। সেই মুক্তি হলো অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক মুক্তি। তিনি কৃষক ও শ্রমজীবী মানুষের ভাগ্য উন্নয়নের লক্ষ্যে সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক অবকাঠামো উন্নয়নে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন। পরিকল্পিত উন্নয়নের ওপর ভিত্তি করে বঙ্গবন্ধু আধুনিক রাষ্ট্রের রূপরেখা প্রণয়ন করেছিলেন, যা দেশের প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় (১৯৭৩-১৯৭৮) প্রতিফলিত হয়েছিল। তার সুযোগ্য উত্তরাধিকারী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ ও দূরদর্শী নেতৃত্বে বাংলাদেশ ২০১৫ সালে এমডিজির অধিকাংশ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনসহ নিম্ন-মধ্য আয়ের দেশের মর্যাদায় উন্নীত হয়েছে। বাংলাদেশ ২০১৮ সালে প্রথমবারের মতো স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তীর্ণ হওয়ার সকল শর্ত পূরণ করেছে। অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের বিভিন্ন সূচকে বাংলাদেশ অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করেছে। কিছু কিছু সূচকে বাংলাদেশ প্রতিবেশী দেশগুলোর চেয়ে অনেক এগিয়ে আছে। বাংলাদেশ আজ এশিয়ার সর্বোচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জনকারী দেশ। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও এখন ৪১ বিলিয়ন ডলারের ওপরে। দেশ স্বাধীন হবার সময় আমাদের গড় আয়ু ছিল ৪৭, এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭২ বছরের ওপরে। প্রাথমিক স্কুলে যাওয়া ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা প্রায় শতভাগ। সাক্ষরতার হার ৭৪ দশমিক ৭ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। শিশু ও মাতৃ মৃত্যুহার হ্রাস পেয়েছে। বর্তমান সরকারের সময়েই সারাদেশে ৫৬০টি মডেল মসজিদ নির্মাণ করা হচ্ছে। পোশাক রপ্তানিতে এবং ইন্টারনেট ভিত্তিক কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে বাংলাদেশ আজ বিশ্বে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। বাংলাদেশ এখন বিশ্বে মিঠাপানির মাছ উৎপাদনে তৃতীয়, ছাগলের মাংস উৎপাদনে পঞ্চম, ধান উৎপাদনে চতুর্থ, আম উৎপাদনে সপ্তম, সবজি উৎপাদনে তৃতীয়, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানিতে তৃতীয় এবং পাট রপ্তানিতে প্রথম। কৃষিজমির পরিমাণ ক্রমান্বয়ে কমলেও খাদ্য উৎপাদনে আজ আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ। বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য উত্তরসূরি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ ও দূরদর্শী নেতৃত্বের ফলে ২০০৫ সালে যেখানে দারিদ্র্যের হার ছিল ৪০ দশমিক ০ শতাংশ সেখানে ২০১৯ সালে দারিদ্র্যের হার ২০ দশমিক ৫ শতাংশে নেমে এসেছে।
৩০. বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার লক্ষ্যে সরকার 'রূপকল্প-২০৪১' কে সামনে রেখে বহুমাত্রিক কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। ক্ষুধা, দারিদ্র্যমুক্ত, উন্নত ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ বিনির্মাণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উন্নয়ন দর্শন 'রূপকল্প ২০৪১'-এর প্রধান অভীষ্ট হলো ২০৩১ সালের মধ্যে চরম দারিদ্র্যের অবসান, উচ্চ-মধ্য আয়ের দেশের মর্যাদায় উত্তরণ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে দারিদ্র্যের অবলুপ্তিসহ উচ্চ আয়ের দেশের মর্যাদায় আসীন হওয়া যেখানে মাথাপিছু আয় হবে ১২ হাজার ৫০০ মার্কিন ডলারেরও বেশি। এ লক্ষ্য বাস্তবায়নে ২০২১-২০৪১ মেয়াদে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৯ শতাংশে উন্নীত করা প্রয়োজন। সেই সঙ্গে নিশ্চিত করতে হবে পুষ্টি ও খাদ্য নিরাপত্তা, ব্যাপক শিল্পায়ন, অর্থনীতি সুসংহতকরণ, নগরায়ণ, শতভাগ বিদ্যুতায়ন, জ্বালানি বহুমুখীকরণ, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলাসহ মেধাভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণ।
৩১. স্বপ্নের পদ্মা সেতু নির্মাণ এখন সমাপ্তির পথে। মেট্রোরেলের কাজ চলছে, পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দরের কাজ এগিয়ে যাচ্ছে। চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে বহুলেন টানেল নির্মাণের প্রথম টানেল সমাপ্ত হয়েছে। সমগ্র বাংলাদেশে রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা সম্প্রসারণ করা হচ্ছে। মাতারবাড়ীতে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করা হবে। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট, পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের পর এবার ঢাকার যাত্রাবাড়ী থেকে মাওয়া হয়ে ফরিদপুরের ভাঙ্গা পর্যন্ত আন্তর্জাতিক মানের এক্সপ্রেস হাইওয়ের যুগে পা রাখল বাংলাদেশ। গত ১২ মার্চ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে গণভবন থেকে এটি উদ্বোধন করেছেন, যা জাতির জন্য মুজিববর্ষের এক অনন্য উপহার। এছাড়া দেশের আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রমকে সুচারু ও সহজলভ্য করতে ঢাকা-চট্টগ্রাম নৌ রুটকে কার্যকর করে তোলার জন্য বৃহৎ একটি প্রকল্প অনুমোদিত হয়েছে।
৩২. ক্রীড়া ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ অসামান্য সাফল্য অর্জন করেছে। অনূর্ধ্ব-১৯ ক্রিকেট দল বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করেছে। বাংলাদেশের মেয়েরা এশিয়া কাপ ক্রিকেটে শিরোপা জয় করেছে। এছাড়া বিভিন্ন খেলাধুলায়ও এগিয়ে যাচ্ছে।
৩৩. এ সরকারের অন্যতম কৃতিত্ব হচ্ছে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার সম্পন্ন করা। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার এখনও চলমান। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় এ বিচার অন্যতম মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
৩৪. জলে-স্থলে-আকাশে বাংলাদেশের অবস্থান সুদৃঢ় করতে চেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। তিনি বাংলাকে সোনার বাংলা হিসেবে গড়তে চেয়েছিলেন। আজ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেই আরাধ্য কাজ সম্পন্ন করেছেন, বাংলাদেশের স্থল ও সমুদ্রসীমা স্থায়ীভাবে নির্ধারণ করেছেন। ৫৭তম দেশ হিসেবে বাংলাদেশ মহাকাশে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট পাঠিয়েছে, যা সফলভাবে কাজ করছে।
৩৫. নোবেল বিজয়ী ভারতীয় অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক আয়োজিত একটি ভার্চুয়াল আলোচনা অনুষ্ঠানে বলেছেন, আর্থসামাজিক অগ্রগতিতে বাংলাদেশ অন্যান্য দেশের জন্য উদাহরণ। যে ধরনের কাজের ভিত্তিতে একটা দেশ এগিয়ে যায়, যাতে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো সফল হয়, সেই ব্যবস্থার মাধ্যমে অন্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে অনেক বেশি সাফল্য এসেছে। এজন্য তিনি নারীর অবদানের কথা উল্লেখ করেছেন।
৩৬. ১৬ কোটি জনসংখ্যা অধ্যুষিত এদেশে নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও শুধু মানবিক বিবেচনায় পার্শ্ববর্তী দেশ মিয়ানমার থেকে আসা প্রায় ১০ লাখ বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা শরণার্থীকে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে। এসব শরণার্থীকে নিজ দেশে সসম্মানে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য বাংলাদেশ জাতিসংঘসহ বিশ্ব ফোরামে বারবার বিষয়টি উত্থাপন করেছে। ইতোমধ্যে রোহিঙ্গাদের ওপর পাশবিক নির্যাতন, গণহত্যা
Comments (0)