আজকে খুব ভোরে ঘুম ভাঙলো রুপার। আসলে টেনসনে সারারাত ভালোভাবে ঘুমাতে পারেনি । ভোর তিনটার দিকে একবার ঘুম ভাঙলো । মনে হলো বুঝি সকাল হয়ে গেছে । ঘড়ি দেখে বুঝতে পারলো রাত তিনটা । মোবাইলটা হাতের কাছে ছিল না। তাই আবার ঘুমিয়ে পড়ল । তা না হলে মোবাইল দেখেই হয়তো বাকি রাতটা পার হয়ে যেত।
কালকে থেকেই উত্তেজনায় ছটফট করছে রূপা ।আজকে সারাদিন অনেক প্লান । তবে তার আগে চট করে এক কাপ চা খেতে হবে । বিছানা ছেড়ে চোখে মুখে পানি দিয়ে চুলায় পানি দিল ।
পাঞ্জাবিটা পড়ে নিয়ে বাদল উবার কল দিল। সাধারণত সকালবেলা উবার থাকে । কিন্তু আজকে শুক্রবার। ম্যাপের মধ্যে কোন গাড়ি নাই । অন্য সময়তো কিলবিল করতে থাকে । আর আজকে পৃথিবীর সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ দিন আর আজকেই নাই। মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল বাদলের । এই উবারের জন্য সারাদিন তার কথা শুনতে হবে রূপা আপুর কাছে।
যেভাবেই হোক একটা কিছু ম্যানেজ করে রূপা আপার বাসায় সময়মতো পৌঁছাতে হবে । সারাদিনের ব্যাপক প্ল্যান। আপাকে নিয়ে যেতে হবে হিমু ভাইয়ের বাসায়। তাকে ঘুম থেকে উঠাতে হবে। আপার বিশেষ মিশন সফল করতে হিমু ভাইকে আজকে অবশ্যই গোসল করতে হবে । উনি করোনাকালে গোসল করা বন্ধ করে দিয়েছেন। উনার ধারনা শরীরের ভেতরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা গোসল করলে কমে যায় । আর ভাইরাস শরীরের বাইরের ঘামের ভেতরের ব্যাকটেরিয়ার সাথে যুদ্ধ করে সেখানেই পরাস্ত হয় । এখন পর্যন্ত মাশাল্লাহ এই থিউরি কাজ করছে। ভাই সুস্থ আছেন। উনি না থাকলে বিশ্বাসী হতোনা বিজ্ঞানের ওপরেও জ্ঞান আছে ! মারাত্মক জিনিস।
উবার পাওয়া গেছে । ফোন বাজল।
- স্লামালিকুম স্যার
- ভাই আপনি কোথায় আছেন ?
- এইতো স্যার বনানী 11 নম্বর ব্রিজ
- আচ্ছা ঠিক আছে । ব্রিজ থেকে সোজা চলে আসেন হাতের বায়ের দ্বিতীয় গলি । আমি নিচে নামতেছি।
রুপা আর বাদলকে দেখে হিমুর মনে হল তার সাময়িক হেলুসিনেশন হচ্ছে। কিন্তু কেন হবে ?গোসল না করার কারণে হতে পারে। করোনাভাইরাস নাক মুখ দিয়ে ঢুকে ফুসফুসে না গিয়ে ভুল করে উপরের দিকে উঠে গেছে । সরাসরি মাথায় । সেখানে গিয়ে সে রংবাজি শুরু করে দিয়েছে । প্রিয় মানুষ গুলোকে সামনে ধরে ধরে আনছে । বিষয়টা ঘুমানো অবস্থায় করলে ঠিক ছিল কিন্তু এখন জেগে থাকা অবস্থাতেই শুরু হয়ে গেছে। লক্ষণ সুবিধার না।
ঘুম থেকে চোখ খুলেই হিমু তাকিয়ে রইল রূপার দিকে। নীল শাড়িতে ওকে ভয়ঙ্কর সুন্দর লাগছে । রূপার মুখ মায়াবতী। বড়ই মায়াবতী । হিমুর নড়তে-চড়তে ইচ্ছা করছে না । মনে হচ্ছে সারা দিন এভাবে বিছানায় উপুড় হয়ে রুপার দিকে তাকিয়ে থাকলেই তো হয় । সেটা সম্ভব নয় । প্রকৃতি ভয়ঙ্কর সুন্দর মুহূর্ত খুব বেশিক্ষণ দেখতে দেয় না।
- তুমি কি উঠবা নাকি আইইডিসিআরে ফোন দিব?
- আচ্ছা আচ্ছা উঠলাম !
- এই নাও এটা পড়ো
- এটা কি আনছো ? আমার পাঞ্জাবীটা কই ?
- আজকে পাঞ্জাবি পরতে হবে না । হলুদ রঙের এই টিশার্ট টা পড়ো
- হিমুরা টি-শার্ট পড়ে না
- আচ্ছা ঠিক আছে বুঝলাম , আমার হিমু আজকে টি-শার্ট পড়বে
- কেন আজকে কি পহেলা বসন্ত
- না তার থেকেও গুরুত্বপূর্ণ। আজকে স্যারের জন্মদিন। আমরা এখন স্যারের বাসায় যাব । কেক কাটবো। তোমাকে নিয়ে গিয়ে সারপ্রাইজ দিবো ।
হিমুর চোখে পানি চলে আসলো । সে সাধারন মানুষ হতে চায়নি। মহাপুরুষ হতে চেয়েছে । তবুও তার চোখে পানি চলে আসলো ।চোখের পানি ভয়ংকর জিনিস ।তবে তার চেয়েও ভয়ঙ্কর সুন্দর হুমায়ুন স্যার । সমস্যা হচ্ছে উনাকে সারপ্রাইজ দেওয়া প্রায় অসম্ভব বরং নিজেই টাশকি খেয়ে কিছুক্ষণ বসে থাকতে হয়।
- এবার উঠ ! তাড়াতাড়ি গোসল সেরে নাও! আমি চা বানাচ্ছি। চা খেয়ে আমরা স্যারের বাসায় যাচ্ছি।
হিমু বাথ রুমে ঢুকতেই রূপার ফোন বেজে উঠল।
- হ্যালো রূপা
- জি কানা বাবা বলেন
- রিকোয়েস্ট করতে ফোন করেছি
- জ্বী বলেন , আপনার রিকোয়েস্ট আজকে তো আদেশের মত
- রুপা আজকে হুমায়ুন স্যারের জন্মদিন । আমি স্যারকে শুভেচ্ছা জানাতে এসেছি । কিন্তু উনার বাসা খুঁজে পাচ্ছিনা। হয় আমি ওনার বাসার ঠিকানা ভুলে গেছি অথবা উনি ঠিকানা পাল্টে ফেলেছেন। কি করা যায় বলেন তো ।
- শুভ্র আপনি চশমা পড়ে এসেছেন তো?
- না সমস্যা এখানেই হয়েছে্। উত্তেজনায় চশমা ফেলে চলে এসেছি। এখন গলির ভেতর ঘোরাঘুরি করছি । সব বাসা এক রকমই দেখাচ্ছে । বাকের ভাই কেউ খুঁজে পাচ্ছিনা উনার তো আবার ফোন নাই কি করি বলেন তো?
- আচ্ছা ঠিক আছে আপনি থাকুন আমি আসছি
লিফটের সেভেন মানে যে ৮ তলা এটা অনেকেরই মনে থাকেনা। ঠিকানাটা নিয়ে মিসির আলি কনফিউজড । কনফিউশন ভয়ংকর জিনিস। বিশেষ করে এটা যদি সংখ্যা নিয়ে হয়। মিসির আলি দ্বিধা নিয়ে কলিং বেল চাপ দেন। যিনি দরজা খুললেন তাকে দেখে মিছির আলীর হিংসা হল। বয়সে উনার সমসাময়িক হবেন কিন্তু কি প্রচন্ড তরুণ। জিন্সের শার্ট জিন্সের প্যান্ট টাকমাথার কপালে চশমা।
- আপনাকে তো ঠিক চিনতে পারলাম না! কাকে চাইছেন?
- জি আপনি আমাকে চিনতে না পারলেও আমি আপনাকে ঠিকই চিনেছি । আপনি হক সাহেব। আমাদের সৈয়দ হক । আমার নাম মিসির আলি। আমি আসলে হুমায়ূন স্যারকে খুজছিলাম ।
- ও তাই বলুন! তাইতো আমার প্রথমেই চেনা উচিত ছিল ! আপনিতো সাততলায় এসেছেন। উনি আমার উপরের তলায় থাকেন। চলুন আমিও উনার ঘরেই যাচ্ছি।লিফটে যাবো না হেটে উঠেছি কেমন ?
- জি অবশ্যই ।
হিমু রুপা বাদল আর শুভ্র যখন স্যারের বাসা খুঁজে পেল তখন দুপুর দেড়টা। ঘরে ঢুকেই হিমু চমকে উঠলো । বাচ্চাদের জন্মদিনের মতো আয়োজন । সৈয়দ হক, আনিসুজ্জামান স্যার, গোলাম মোস্তফা সাহেব সবাই সোফায় বসে আড্ডা মারছেন । বাচ্চু ভাই একপাশে বসে গিটার বাজাচ্ছেন। ড্রইং রূমের কার্পেটে বসে রয়েছেন বারী সিদ্দিকী । তার হাতে বাঁশি । বাচ্চুর সাথে টিউন ঠিক করে নিচ্ছেন। পাশেই সুবীর নন্দী বসে একটা সুর গুনগুন করছেন।
হিমু ধীর পায়ে মিসির আলীর দিকে এগিয়ে গেল।
- স্লামালিকুম স্যার ! আপনি কখন আসলেন ?
- এইতো আসলাম
- স্যার , হুমায়ূন স্যারকে দেখছিনা !
- বার্থ ডে বয় তো - আজকে ভীষণ ব্যস্ত! সবাইকে সারপ্রাইজ দিচ্ছেন। সারা জীবন নাটক সিনেমা উপন্যাস করে বেরিয়েছেন। শিল্পের একটা মাধ্যম নাকি উনার কাজ করা হয়নি। আর তাই আজকে উনি সবাইকে রান্না করে খাওয়াবেন। ভুনা খিচুড়ি আর ইলিশ মাছ। ভুনা খিচুড়ি ম্যানেজ করেছেন ঠিকঠাক। কিন্তু আমার ধারণা ইলিশ মাছে গিয়ে ফেঁসে গেছেন। সেই তখন থেকে রান্নাঘরে কাউকে ঢুকতে দিচ্ছে না । আমার ধারণা ইউটিউব ভিডিও দেখে ইলিশ মাছটা দাঁড় করাবেন।
শোনা মাত্রই নাকে ইলিশ মাছ ভাজা গন্ধ টের পেল হিমু । যাক বাবা বাঁচা গেল ! এই যাত্রা করোনা হয়নি!
সুবীর নন্দী আর বারি সিদ্দিকি কানাঘুষা করছেন।
- বারি ভাই আপনাকে একটা বুদ্ধি দেই ! শোনেন স্যার রান্না করে আমাদেরকে সারপ্রাইজ দিচ্ছেন। আপনিও তাকে একটা সারপ্রাইজ দেন।
- কিভাবে সুবীরদা!??
- আপনি আজকে একটা রবীন্দ্র সংগীত গান!
বারী সিদ্দিকী ফ্যাঁসফ্যাঁসে গলায় গান ধরলেন।
" তখন আমায় নাইবা মনে রাখলে
তারার পানে চেয়ে চেয়ে
নাইবা আমায় ডাকলে
যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে"
রুপা গলা মেলালো। একে একে ঘরের সবাই গাইতে শুরু করল।
ভয়ঙ্কর সৌন্দর্যের সামনে আসলে হিমুর চোখের পানি চলে আসে । এই ঘরের মানুষগুলো সেটা তৈরি করতে শুরু করেছে ।
প্রকৃতি এই ভয়ঙ্কর সুন্দর কতক্ষণ সহ্য করবে কে জানে !
Comments (0)