শেষ মুহূর্তে

 

হাঁসপাতালের কটু গন্ধটা নাকে সয়ে গেছে,

প্রথম প্রথম বমি আসতে এখন আর কোন সমস্যা

হয়না। আগে কারো মৃত্যুর সংবাদ শুনলে বুকটা

ধরফর করে উঠতো, এখন তো রোজ মৃত্যু দেখা

হয়। ওইতো সেদিন একটা জোয়ান ছেলে ছটফট

করতে করতে মারা গেলো, মরার আগে বারবার

একটা মেয়ের নাম বলছিলো। কি দরকার

ছিলো বিষ খাওয়ার।

আজ সেই বেডটাতে এক মধ্যবয়সি লোক শুয়ে

আছে, পাশেই কমবয়সি একটা মেয়ে। লোকটার

স্ত্রী, মেয়েটা সেই সকাল থেকেই কাঁদছে।

কিছুক্ষন আগে লোকটা ধমক দিয়ে মেয়েটাকে

চুপ করিয়েছে। লোকটা ঘুমাচ্ছে, মেয়েটা

এখনো মাঝে মাঝে ফুঁফিয়ে কেঁদে উঠছে।

লোকটার কি হয়েছে কে জানে। আহারে

মেয়েটার জন্য বড় কষ্ট হচ্ছে।

.

মাগরিবের আজান দিচ্ছে, রেহানা মাথার

কাপড়টা ঠিক করে নিলো। পাশেই পাকা চুল,

খোঁচাখোঁচা দাড়ি মুখের লোকটা ঘুমাচ্ছে।

লোকটা রেহানার স্বামী। এই লোকাটার

সাথে জীবনের চল্লিশটা বছর কাটিয়েছে

রেহানা।

রেহানা তার স্বামী নুর হোসেনকে ডাক

দিলেনঃ

.

--শুনেন, আজান দিতাছে একটু উইঠা বসেন।

.

রেহানার ডাকে নুর হোসেন চোখ না খুলে বুক

পকেটে হাত দিলেন। পকেট থেকে টাকা বের

করে চোখ না খুলেই বললেনঃ

.

-ভাইয়া আসছিস তুই? এই নে তোর টাকা। তোর

জন্য রাইখা দিছিলাম। তোর দাদিকেও

দেইনাই। তোর না পরিক্ষা কিছু কিনিস। নে

ভাই নে…

.

রেহানা নুর হোসেনের হাত ধরে বললেনঃ

--কারে টাকা দেন। চোখ খুলেন।

.

-আসাদ আসেনাই বউ?

.

--না, আপনি খোয়াব দেখছেন। তার তো

পরিক্ষা চলে।

.

-ও… আচ্ছা। বৌ টাকাটা তোমার কাছে

রাইখা দাও। আসাদ আসলে তারে দিয়ো।

.

--আপনার কাছে রাখেন। সে আসলে আপনি

দিয়েন।

.

-আমার কি ঠিক আছে বৌ, যে কোন সময়

উপরওয়ালার ডাক আসতে পারে।

.

--আপনারে কতোবার কইছিনা এমন কথা বলবেন

না, আপনি এমন করে বলেন ক্যান।

.

-গস্বা হইয়োনা বৌ। আচ্ছা আর কমুনা।

.

রেহানার বুকটা ধরফর করে উঠে যখন নুর

হোসের মরার কথা বলে। এই মানুষটাকে ছেড়ে

কিভাবে থাকবে সে। সারাজীবন যার সাথে

কাটিয়ে দিলো তাকে ছাড়া জীবন কেমন হবে

সেটা ভাবতেই রেহানার বুক ভেঙ্গে কান্না

আসে, চোখ ছলছল করে। এই মানুষটার সাথে

কতো স্মৃতি। রেহানার চোখে নুর হোসেন মানুষ

না, মানুষ রূপে ফেরেশতা। একটা মানুষ এতো

ভালো হয় কিভাবে।

.

বাপ-মা মরার পর রেহানা যখন অসহায় হয়ে

পড়ে, যখন সমাজের পুরুষদের ললুপ দৃষ্টি তার

দিকে তখন নুর হোসেন পরিবারের অমতে বিয়ে

করে রেহানাকে। কেউ কোন খোটা দিলে নুর

হোসেন সাথে সাথে প্রতিবাদ করতো, সবসময়

রেহানার পক্ষ নিয়ে কথা বলতো।

রেহানা রান্না পারতোনা, কখনো ঝাল বেশি

হতো কখনো বা লবন। কিন্তু নুর হোসেন সবসময়

হাসি মুখে খেতো। খাওয়ার সময় বলতোঃ

.

-বৌ অনেক সোয়াদ হইছে, আরেকটু দাও।

.

.

রেহানার আজও মনে পড়ে যেদিন রাসেলের

জন্ম হয়। ছেলেকে কোলে নিয়ে নুর হোসেনের

সে কি কান্না। সারা মহল্লায় মিষ্টি বিলি

করছিলো। সময় কতো জলদি যায়। পুরোনো কথা

ভেবে রেহানার চোখে পানি চলে আসে,

দুঃখের না সুখের।

.

নুর হোসের কথায় ভাবনা ফিরে এলো

রেহানাঃ

-বৌ ইলিশ মাছ ভাজা দিয়ে ভাত খাইতে মন

চায়।

.

--এখন ইলিশ মাছ কোথায় পাবো। আপনার

ছেলে আসুক বলবো। কাল দুপুরে আইন্না দিবে।

.

-বৌ এখন খাইতে মন চায়। আচ্ছা থাউক তুমি কই

পাইবা এখন।

.

.

নুর হোসেন আবার ঘুমিয়ে পড়ে। রেহানা

মানুষটার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।

চাদরটা বুক পর্যন্ত টেনে দিয়ে বেড়িয়ে পড়ে।

তার কাছে টাকা নেই, হেঁটে হেঁটে বাসা এসে

দেখে বৌমা ঘরে টিভিতে সিরিয়াল দেখছে।

আসাদ পড়তে বসছে। রেহানা বৌমার ঘরে

আসে, রেহানাকে দেখে বৌমা জিজ্ঞাসা

করেঃ

.

--মা আপনি এখানে। কোন খারাপ সংবাদ

নাকি?

.

-তোমার শশুড় ইলিশ মাছ ভাজা দিয়ে ভাত

খাইতে চাইছে।

.

--ইলিশ মাছ কই পাবেন। তাছাড়া রাতের

রান্না তো হয়ে গেছে। কাল নাহয় দেখা

যাবে।

.

-ফ্রিজে দেখ না মা। রাসেল বলছিলো কাল

নাকি ইলিশ মাছ আনছিলো।

.

--আমি কি মিথ্যা বলছি? বিশ্বাস না হলে

ফ্রিজ খুলে দেখেন।

.

রেহানা ফ্রিজ খুলে দেখে মাছ আছে। সে আর

কথা বাড়ায়না। আচল দিয়ে চোখ মুছে

বেড়িয়ে পরে। মানুষটা একা আছে, চোখ

খুললেই খুঁজবে। ডাকাডাকি করবেঃ

-বৌ কই গেলা।

.

রেহানা হাঁটছে, ইস মানুষটা কতোটা আশা

করছিলো। একটা সময় ছিলো যখন বাজারের বড়

মাছটা নিয়ে আসতো। রাতে নিজে ভেজে

ছেলের পাতে মাথাটা দিতো। বলতোঃ

.

-খা বেটা। বাজারের বড় মাছটা এনেছি। বৌ

তুমিও নাও।

.

রেহানা বলতোঃ

--মাথাটা আপনি নিতেন, কতো আশা করে

আনছিলেন। ছেলেকে তো সবসময় খাওয়াই।

তাছাড়া ও বাচ্চা পোলা, মাথাটা তো খেতে

পারবোনা নষ্ট করবো।

.

নুর হোসেন দৃঢ় কন্ঠে বলতেনঃ

--ছোট বেলায় আব্বা আমারে এমনি কইরা

খাওয়াইতো। বলতো পোলা বড় হইলে আমারে

কিইন্না খাওয়াইবে। বাপরে খাওয়াই তে

পারিনাই। কলেরায় মরলো, পোলাই খাউক।

.

হাঁসপাতালে ফিরতেই রেহানার মাথা ঘুরে

উঠলো। নুর হোসেনের মুখ পর্যন্ত সাদা কাপড়

দেয়া। রেহানা ফ্লোরে বসে পড়লো। তার

কান্না পাচ্ছেনা। অতি শোকে মানুষ কাঁদতে

পারেনা। তার আফসোস হচ্ছে মানুষটার শেষ

ইচ্ছা সে পূরণ করতে পারলোনা।

আচ্ছা মানুষটা কি শেষ সময়ে তাকে

খুঁজছিলো?

কিছু কি বলতে চেয়েছিলো?

শেষ কথা।।

.

রেহানার কপাল কি এতো খারাপ যেই

মানুষটার সাথে সারা জীবন কাটালো তার

শেষ মুহূর্তে পাশে থাকতে পারলোনা।

মানুষটা মাঝে মাঝে বলতোঃ

.

-বৌ মরার সময় তোমার মুখটা একবার যেন

যেখতে পাই। তাহলে মরেও শান্তি।

Posted in Personal Blogs on October 16 2020 at 04:50 PM

Comments (1)

No login
color_lens
gif